খরার প্রভাব-খরার ক্ষতিকর প্রভাব
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে খরার প্রভাব-খরার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমূহের মধ্যে খরা অন্যতম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা বিশ্বের সর্বত্র আঘাত হানে। খরার ফলশ্রুতিতে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি খরা সমগ্র সমাজ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খরার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।আফ্রিকার অপুষ্টি, দারিদ্র্য,রোগ-ব্যাধি, দ্বন্দ্ব সংঘাত প্রভৃতি সৃষ্টিতে রয়েছে এর বিশেষ ভূমিকা।সমগ্র বিশ্বের অনেকটা নিরবে খরা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগটি আঘাত হেনে চলেছে।
খরার প্রভাব/খরার ক্ষতিকর প্রভাব
খরা নীরবে আঘাত হানে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।খরা মানুষের স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ কিনারা ধরে মৌরি তানিয়া থেকে চাদ অবধি যে বিশাল অঞ্চল সাহেল নামে পরিচিত সেখানে সত্তরের দশক থেকে চলছে এক মর্মান্তিক খরা।এটা পরে দেখা যায় বিস্তৃত হয়েছে সুদান আর ইথিওপিয়াতে।এ খরার কারণ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কিছু ঘটনাকে উল্লেখ করা হয়।
ইউরোপের নাতিশীতোষ্ণ উচ্চচাপ অঞ্চলের দক্ষিণ ও পূর্ব অভিমুখের বিস্তার এর মধ্যে একটি। আর একটি কারণ হতে পারে, উত্তর আটলান্টিকের পূর্ব এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্তাপ হ্রাস। পরিবেশগত আর যে কারণটি প্রায়ই উল্লেখিত হয় তা হলো ব্যাপকভাবে উদ্ভিদের বিনাশ।এ বিশাল অঞ্চলের মানুষের একটি প্রধান জীবিকা পশুচারণ। বেপরোয়া ভাবে পশুচারণের ফলে এখানকার তৃণভূমি নষ্ট হয়ে গেছে। যে হারে তৃণ শেষ হয়েছে সে হারে তাকে গজাবার সুযোগ দেয়া হয়নি।
ফলে তৃণহীন নগ্নভূমি সূর্য কিরণ শোষণ করার বদলে এতে প্রতিফলনে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে বেশি। এরকম অবস্থা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গুরুতরভাবে কমিয়ে দিতে পারে। এটাই স্পষ্ট যে, যে ধরনের বেশ কিছু কারণের সম্মিলিত অশুভ যোগ ও বিস্তীর্ণ ও ভয়াবহ খরার সৃষ্টি করেছে।এ রকম খরার সাথে আসে দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর পদধ্বনি। আফ্রিকার ব্যাপক অঞ্চল এমনি এক নিদারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। খরার বিভিন্ন প্রভাব সম্পর্কে নিম্ন আলোচনা করা হলো:
১) স্বাস্থ্যগত প্রভাব
খরা বিভিন্ন রোগব্যাধির বিস্তার ঘটায়। এছাড়াও খরাপ্রবণ এলাকায় খাদ্য উৎপাদন অতিমাত্রায় হ্রাস পায়। ফলে মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে দিন কাটায়। তারা পানি ছাড়াও দুই একদিন কাটিয়ে দেয়। বেশিরভাগ সময় তাদের অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে। ফলে তারা বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। অনেক সময় তারা মৃত্যুবরণ করে। খরার ফলে মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুর খাদ্যস্বল্পতা সৃষ্টি হয়। খরাপ্রবণ এলাকায় গবাদি পশু মানুষের ন্যায় বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্বের ২.৬ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানি সংগ্রহ করতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শুধু ডায়রিয়া জনিত কারণে প্রতিদিন ৩৯০০ শিশু মৃত্যুবরণ করে।
২) সামাজিক প্রভাব
খরা সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে।নিম্নে খরার সামাজিক প্রভাব আলোচনা করা হলো:
ক) স্থানান্তর বৃদ্ধি
খরার ফলে মানুষ উৎপাদনমূলক কর্মকান্ড থেকে দূরে সরে পড়ে।খরাপ্রবন এলাকায় মানুষ জীবন ও জীবিকার সন্ধানে স্থানান্তর ঘটায়। মেক্সিকো থেকে প্রতিবছর ৭ লক্ষ থেকে ৯ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে আমেরিকায় স্থানান্তর ঘটায়।
খ) অপুষ্টি
খরার ফলে অপুষ্টি দেখা দেয়। এছাড়াও দেখা যায় যে খরাপ্রবণ অঞ্চলে একদিকে যেমন উৎপাদন হ্রাস পায়, তেমনি মানুষের আয়-উপার্জনও কমে যায়। সাধারণ মানুষ পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।খরার ফলে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ও অপুষ্টির শিকার হয়।
গ) দারিদ্র্য
খরার প্রভাব চরম দারিদ্র্যতার সৃষ্টি করে। উৎপাদন স্বল্পতা থেকে মানুষ প্রাথমিকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এছাড়াও খরাপ্রবণ এলাকায় মানুষের কাজের অভাব, রোগ-ব্যাধির বিস্তার, দ্বন্দ্ব সংঘাত প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।এসব বিষয় মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে আটকে রাখে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান (২০০৩) বলেন, Because the poor often farm degraded land that is increasingly unable to meet their needs,desertification is both a cause and a consequence of poverty."(www.mindfull.org)
ঘ) দুর্ভিক্ষ
খরাপ্রবণ এলাকায় খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাধারণ মানুষ এ সময় চরম দারিদ্র্যের শিকার হয়। খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য থাকায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসে। বৃহৎ পরিসরে এরূপ অবস্থায় সৃষ্টি থেকে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
ঙ) অপরাধ বৃদ্ধি
খরার প্রভাব অপরাধ বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে। খরার ফলে মানুষ দারিদ্রের মধ্যে পতিত হয়। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। সমাজে মাদক, চোরাচালান, সন্ত্রাস, চুরি, খুন, লুটতরাজ প্রভৃতি দেখা দেয়।
চ) গোষ্ঠী সংঘাত
খরার ফলে সৃষ্ট খাদ্য সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দা থেকে গোষ্ঠী সংঘাত সৃষ্টি হয়।আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন খরা প্রবণ এলাকায় গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা যায়।
৩) রাজনৈতিক প্রভাব
খরার প্রভাব রাজনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে। এছাড়াও বিশ্বের খরাপ্রবণ দেশসমূহে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দারিদ্র,খাদ্যাভাব, কর্মসংস্থানের অভাব, অপুষ্টি, রোগ ব্যাধি, মৃত্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনা গ্রহণের প্রভাব সৃষ্টি করে।
৪) অর্থনৈতিক প্রভাব
খরার প্রভাবে অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। খরার অর্থনৈতিক প্রভাবসমূহ নিম্নরূপ বর্ণিত হল:
ক) আমদানি রপ্তানির ভারসাম্যহীনতা
খরার ফলশ্রুতিতে একটি দেশের অর্থনীতিতে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়াও খরা খাদ্য উৎপাদন হ্রাস করে। দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদন কমে যায়, তেমনি খাদ্য আমদানির জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় হয়, যা একটি দেশের আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে।
খ) কর্মসংস্থানের অভাব
খরাপ্রবণ এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাব সৃষ্টি হয়। ভূমিতে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব না হওয়ায় মানুষ কর্মহীন জীবন যাপনে বাধ্য হয়।
গ) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
খরার প্রভাব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উপর ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে।খরাপ্রবণ এলাকায় খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদনের স্বল্পতা থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
৫) পরিবেশগত প্রভাব
খরা সমগ্র পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তোলে। খরা যে সমস্ত পরিবেশগত প্রভাব বিস্তার করে সেগুলো নিম্নরূপ:
ক) গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া
বিশ্বের খরাপ্রবণ অঞ্চলসমূহে গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী বিভিন্ন গ্যাস যেমন:মিথেন,কার্বন ডাই-অক্সাই, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। এসব গ্যাস বায়ুমণ্ডলের সাথে মিশে গ্রীনহাউসের ন্যায় তাপমাত্রা ধরে রাখে।ফলে সমগ্র এলাকা জুড়ে বাতাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।খরাপ্রবণ এলাকায় গাছপালা কম থাকায় কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতি বায়ুমন্ডলে সর্বদা থেকে যায়।
খ) জলবায়ু পরিবর্তন
খরার প্রভাব জলবায়ু পরিবর্তনে উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।খরাপ্রবণ অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে চলেছে। কার্বন ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ বিশ্বে প্রতিবছর ০.৪% করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।১৭৫০ সালে বিশ্বে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ ছিল ২৪০ পিপিএম। ১৯৯৯ সালে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬০ পিপিএম-এ পৌঁছায়।
Office of Technology Assesment (OTA,1993) এর তথ্য মতে (৭০%-৯০%) কার্বন ডাই- অক্সাইড বায়ুমন্ডলে যুক্ত হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার এবং বন ধ্বংস করণের ফলে একইভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে মিথেন, নাইট্রাইট অক্সাইড এবং ক্লোরো-ফ্লোরো কার্বন।
বর্তমান হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেতে থাকলে আগামী ২১০০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। খরার ফলে বিশ্বের বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এসিড বৃষ্টি, উষ্ণ প্রবাহসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ) জীববৈচিত্র্য ধ্বংস
খরাপ্রবণ এলাকায় উদ্ভিদ ও প্রাণীর বংশ বৃদ্ধি হ্রাস পায়।খরাপ্রবণ এলাকায় কোন বনভূমি গড়ে উঠে না। ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।খরাপ্রবণ এলাকায় পানির স্বল্পতা (কখনো কখনো তীব্র অভাব) থাকায় উদ্ভিদ খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। কোষের বংশবৃদ্ধি এর ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে কোষের মৃত্যু ঘটে এবং গাছপালা মারা যায়।পানির অভাবে প্রাণী জগতেও একই ধরনের প্রভাব পড়ে।
ঘ) ফসলের উৎপাদন হ্রাস
সকল ধরনের ফসল উৎপাদন নির্ভর করে অনুকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। পর্যাপ্ত আলো, তাপ ও পানি সকল ধরনের ফসল উৎপাদনের অন্যতম পূর্বশর্ত। এ তিনটি উৎপাদনের কোন একটি অভাব দেখা দিলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়।খরাপ্রবণ এলাকায় পানির স্বল্পতা সৃষ্টি হয়, ফলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়। করার ফলে ফসল উৎপাদনে যে সমস্ত কারণে ব্যাহত হয় সেগুলো নিম্নরূপ:
- কোষের প্রোটোপ্লাজমের জন্য পানি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পানির অভাবে প্রোটোপ্লাজমের কার্যকারিতা হ্রাস পায় এবং কোষ মারা যায়।
- পানির অনুপস্থিতিতে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
- প্রোটোপ্লাজমের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার ফলে নতুন কোষ গঠন বাধাগ্রস্ত হয়।
- মাটি থেকে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ গ্রহণের বাধার সৃষ্টি হয়।
- সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় উদ্ভিদের শর্করা উৎপাদন কমে যায়।
- খরা প্রবন এলাকায় পানির অভাব থাকায় উদ্ভিদ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যা ফসল উৎপাদনকে বাধাগ্রস্থ করে তোলে।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা সমগ্র বিশ্বে নীরবে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে।এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। খরা প্রতিরোধের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, চাষের জমি বৃদ্ধি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা প্রভৃতি সম্ভব। সুতরাং আজকের আর্টিকেলের খরার প্রভাব-খরার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।