বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের বর্ণনা দাও
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করব। বাংলাদেশের জলবায়ু মোটামুটি সমভাবাপন্ন।দেশের মাঝামাঝি দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করায় এখানে ক্রান্তীয় জলবায়ু বিরাজ করে। কিন্তু মৌসুমী বায়ুর প্রভাব এ দেশের জলবায়ুর উপর এত বেশি যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত।
সুতরাং আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের বর্ণনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব।তাই আর্টিকেলটি না টেনে সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
ভূমিকা
বাংলাদেশ ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্গত। এদেশের সর্বত্র ও সব সময় একই রকম জলবায়ু পরিলক্ষিত হয় না।ফলে গ্রীষ্মকালে যেমন উত্তরাঞ্চল খুবই উষ্ণ থাকে তেমনি শীতকালে খুব শীতলতা বিরাজ করে। ফলে এদেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্যত্র গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে বিপরীত জলবায়ু বিরাজ করে।
বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চল
বাংলাদেশের উপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে।তাই বাংলাদেশে ক্রান্তীয় জলবায়ুর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ক্রান্তীয় জলবায়ুর প্রভাব লক্ষ্য করা গেলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ুর মধ্যে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। জলবায়ুর বিভিন্নতা অনুযায়ী বাংলাদেশকে ছয়টি জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়। যথা:
১) ক্রান্তীয় সামুদ্রিক জলবায়ু অঞ্চল;
২) ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল;
৩) ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল;
৪) ক্রান্তীয় মৃদু আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল;
৫) উপক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল;
৬) উপক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল;
নিম্নে এইসব জলবায়ু অঞ্চলের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো:
১) ক্রান্তীয় সামুদ্রিক জলবায়ু অঞ্চল
বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল ক্রান্তীয় সামুদ্রিক জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।এ অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্ম ও শীতকালে যথাক্রমে ২৭.২°সেলসিয়াস ও ১৯.৪° সেলসিয়াস।এ অঞ্চলের পূর্ব দিকে অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। কক্সবাজার উপকূলে বার্ষিক ৪৫০ সেন্টিমিটার এবং চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ৩২০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
অথচ বরিশাল জেলার উপকূলে বার্ষিক ১৮০ সেমি. এবং খুলনা জেলার উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রায় ২২০ সেমি. বৃষ্টিপাত হয়। এ অঞ্চলের খুলনা জেলার সমুদ্র উপকূলে ম্যানগ্রোভ অরণ্য লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলবর্তী অঞ্চলের জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে ব্যাপক ফসল হানি ঘটে।
২) ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল
চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল ব্যতীত সমগ্র চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।এ অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ৩৮° সেলসিয়াস এবং বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৫০ সেন্টিমিটার (১০০") অপেক্ষা বেশি।তবে বান্দরবান জেলায় গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০০ সেন্টিমিটারের অধিক। পাহাড়ের আধিক্যের কারণেই এসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি হয়।
৩) ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
বাংলাদেশের প্রায় সমগ্র মধ্যভাগ জুড়ে ক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ুর প্রভাব বিদ্যমান।এ অঞ্চলের দক্ষিণে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের উত্তর ভাগ থেকে শুরু করে উত্তরে বগুড়া জেলা এবং পশ্চিমের ক্রান্তীয় আর্দ্র প্রায় এলাকার পর থেকে শুরু করে পূর্বে সিলেট ও ময়মনসিংহের উপক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।
আরো পড়ুন:বাংলাদেশের জলবায়ুর বর্ণনা দাও
বৃহত্তর খুলনা,বরিশাল পটুয়াখালী ও নোয়াখালী জেলার উপকূল ভাগ ছাড়া অন্যান্য অংশ, যশোরের পূর্বাংশ, ফরিদপুর, ঢাকা, টাঙ্গাইল, জামালপুর ও কুমিল্লা জেলা, ময়মনসিংহ জেলার উত্তর-পূর্বাংশ ছাড়া সমুদয় এলাকা, পাবনা এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশ এ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।এছাড়া এ জলবায়ু অঞ্চলের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যথাক্রমে ৩৯.৪৪°সে. ও ৭.২২ সে.।বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০৩.২ সেমি.।
তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পশ্চিম দিক থেকে পূর্বাংশে বেশি। এ অঞ্চলে ধান, পাট, ইক্ষু ও বিভিন্ন ধরনের রবি শস্য উৎপন্ন হয়।এ অঞ্চলের ভূমি পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং এদের উপনদী ও শাখা নদী বাহিত পলি মাটি দ্বারা গঠিত।তাই এই ভুমি বেশ উর্বর ও কৃষি কাজের উপযোগী। অবশ্য বন্যা ও প্লাবনের কারণে এ অঞ্চলের অনেক স্থানে প্রায় প্রতি বছরই ব্যাপক শস্য হানি ঘটে থাকে।
৪) ক্রান্তীয় মৃদু আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
বৃহত্তর রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলা, পাবনা ও যশোর জেলার পশ্চিমাংশ এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ক্রান্তীয় মৃদু আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।এ অঞ্চলের জলবায়ু আর্দ্রতা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক কম। তুলনামূলকভাবে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতও কম হয়।
এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮° সেলসিয়াস এবং গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫২.৪ সেন্টিমিটার এর নিচে। এ অঞ্চলের জলবায়ু ভারতের গঙ্গা নদীতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ বাঁধের কারণেই এখানকার আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।ধান,পাট,গম,জব,ইক্ষু,ভুট্টা প্রভৃতি এ অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ ফসল।
৫) উপক্রান্তীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল
রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলের দক্ষিণের সামান্য অংশ ছাড়া সমস্ত উত্তরাঞ্চল এ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। এ অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। অর্থাৎ শীতের সময় অত্যাধিক শীত এবং গ্রীষ্মের সময় অত্যধিক গরম পড়ে। এ অঞ্চলে গ্রীষ্মকালের গড় তাপমাত্রা ৩২° সেলসিয়াস এবং শীতকালের গড় তাপমাত্রা ৭.২২°সেলসিয়াস।গড় বৃষ্টিপাত ২০৩ সেন্টিমিটারের বেশি। তবে দক্ষিণ দিক অপেক্ষা উত্তর দিকে ক্রমশ অধিক বৃষ্টি হয়।
৬) উপক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল জলবায়ু অঞ্চল
সমগ্র সিলেট অঞ্চল এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের উত্তর- পূর্বাংশ এ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। এই অঞ্চলের গ্রীষ্মকালের গড় তাপমাত্রা ৩২°সে. এবং শীতকালের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১০° সেলসিয়াস। বাংলাদেশের মধ্যে এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৩০৪.৮ সেন্টিমিটারের অধিক। তবে সিলেটের উত্তর-পূর্ব দিকে কোন কোন বছর ৪০০ সেন্টিমিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে,বাংলাদেশের অবস্থান মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে। সমভাবাপন্ন মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত হলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু পরিলক্ষিত হয়।বিশেষত এসব অঞ্চলের তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের মধ্যে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।আর এই সব তারতম্যের কারণে দেখা যায় অঞ্চলভিত্তিক কৃষিকাজ ও জীবনযাত্রার প্রণালীও কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির।আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের জলবায়ু অঞ্চলের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।