বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের গুরুত্ব আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে আপনাদেরকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানানোর চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি না টেনে সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
বনজ সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভূমিকা
বনজ সম্পদ প্রকৃতির একটি উল্লেখযোগ্য দান।একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বনজ সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বনজ সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।তাছাড়া বনজ সম্পদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় জীবনের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এদেশের মোট জাতীয় আয়ের শতকরা ৪.২৫ ভাগ বনজ সম্পদ থেকে আসে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের গুরুত্ব
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে মোট জাতীয় আয়ে বনজ সম্পদের অবদান ছিল ১. ৭৯ এবং ২০০৬-২০০৭ (সাময়িক) অর্থবছরে দেশের মোট জাতীয় আয়ে বনজ সম্পদের অবদান ধরা হয়েছে ১.৭৬%। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের গুরুত্ব/ভূমিকা আলোচনা করা হলো:
১)নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান
বাংলাদেশের জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর যোগান নিশ্চিতকরণে বনজ সম্পদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এদেশের বন থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন-জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, ফলমূল, মাংস, মধু, মোম ইত্যাদি পাওয়া যায়।
২) আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণ
বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র যেমন- চেয়ার, টেবিল, আলমারি, খাট-পালঙ্ক প্রভৃতি তৈরি করতে কাঠ ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া গৃহনির্মাণের জন্য বন থেকে কাঠ, বাঁশ, বেত,শণ, গোলপাতা ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়।বেত দিয়ে তৈরি আসবাবপত্র অনেকের ঘরেই শোভা পায়।
৩) কৃষি উন্নয়ন
বনজ বৃক্ষের পাতা পচিয়ে সবুজ সার উৎপাদন করে জমিতে প্রয়োগ করলে ফলন ভালো হয়।তাছাড়া বনজ সম্পদ দ্বারা কৃষির বিভিন্ন উপকরণ যেমন-লাঙল, মই ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
৪) শিল্পোন্নয়ন
বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।শিল্পের সর্বাধিক কাঁচামালের যোগান আসে বন থেকে।কাগজ, রাবার,হার্ডবোর্ড, দিয়াশলাই,স্পিরিট, ওষুধ ইত্যাদি প্রস্তুতে বনজ সম্পদ অত্যাবশ্যক।
৫) রাজস্ব আয় বৃদ্ধি
বনজ সম্পদের উপর কর এবং ভ্রমণকারীদের উপর আরোপিত কর থেকে সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া বনজ সম্পদ বিক্রয় করেও সরকার প্রচুর রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে।
৬) কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
বনজ সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত যেমন-বনভূমি এলাকার অনেক মানুষ গাছপালা, গোলপাতা, মধু, মোম, ফলমূল ইত্যাদি সংগ্রহ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সুতরাং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে বনজ সম্পদ এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
৭) পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন
বাংলাদেশের বনভূমির সৌন্দর্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তবে বিশেষ করে সুন্দরবনের দৃশ্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এখানে আসে। এতে পর্যটন শিল্পের উন্নতি ঘটে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
৮) ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে
ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে বনভূমির গুরুত্ব অধিক। কারণ কবিরাজি, হেকিমি, আয়ুর্বেদীয় ওষুধসহ এলোপ্যাথি ওষুধের কাঁচামাল বনের লতাপাতা, গাছগাছালি থেকে সংগৃহীত হয়।
৯) পশুচারণ ক্ষেত্র
বনভূমি পশুচারণ ক্ষেত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কারণ এখানে প্রচুর ঘাস জন্মে। ফলে বনভূমিতে পশুচারণ ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায়, পশুচারণ ক্ষেত্র হিসেবে বনভূমির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
১০) ভূমিক্ষয় রোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ
বিশেষ করে দেখা যায়, বনভূমি মাটির ক্ষয়রোধ করতে সাহায্য করে।বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং খুলনা অঞ্চলের বনভূমি মাটির ক্ষয়রোধ করে দেশকে রক্ষা করছে। তাছাড়া বনভূমি বন্যা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১১) প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বনভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বনভূমি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি রোধ করে থাকে। এতে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।বিশেষ করে দেখা যায় যে, সমুদ্রপকূলীয় বনভূমি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি রক্ষা করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
১২) বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
বনজ সম্পদ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অত্যন্ত সহায়ক। বনজ সম্পদ; যেমন-বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া ও লোম, বন্যহাতি, বানর ইত্যাদি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায় যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।
১৩) প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা
প্রাণীকুল শ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে।অপরদিকে উদ্ভিদরাজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হয়।
১৪)প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে
কোন দেশের সীমান্তে নিবিড় বনভূমি থাকলে বহি:শত্রু সহজে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে বনভূমি প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। বহি:শত্রুর আক্রমণ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার ক্ষেত্রে বনভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৫) পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বনের কাঠ বিশেষ উপকারে আসে। যেমন-রেললাইনের স্লিপার, নৌকা, লঞ্চ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বাস ও ট্রাকের অবকাঠামো তৈরিতে প্রচুর কাঠ ব্যবহৃত হয়।
১৬) জ্বালানি সরবরাহ
জ্বালানি শক্তি হিসেবে বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের জনসাধারণ বিশেষ করে দেখা যায় গ্রামীণ জনসাধারণের জ্বালানি শক্তির প্রায় পুরোটাই বনজ সম্পদ থেকে সংগ্রহ করা হয়।জ্বালানি সরবরাহের উৎস হিসেবে বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৭) মরুভূমির বিস্তার রোধ
বনভূমির গাছের পাতা ভূমিতে পচে ভূমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে জমিতে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয়।এতে মরুভূমি বিস্তার লাভ করতে পারে না।
১৮) বৃষ্টিপাত
আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে বনভূমি বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গাছপালা বেশি থাকায় সেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
১৯) গ্রীন হাউজের প্রভাব প্রতিরোধ
গাছপালা তথা বনভূমি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে গ্রীন হাউজের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে।
২০) চিত্তবিনোদন
বনভূমি চিত্তবিনোদনে বিশেষভাবে সহায়তা করে। দেখা যায় বাংলাদেশের বনভূমি এলাকায় সিনেমার শুটিং, পিকনিক ইত্যাদি উপভোগের মাধ্যমে জনগণ সহজে চিত্তবিনোদন করতে পারে।
২১) বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল
প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন্যপ্রাণী অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল হিসেবে বনভূমির গুরুত্ব ব্যাপক। বন্যপ্রাণীর নিরাপদে বেঁচে থাকা এবং বংশবিস্তারে বনাঞ্চল সহায়তা করে।
২২) ভূগর্ভস্থ পানিস্তর
বনভূমি ভূগর্ভস্থ পানি স্তর ঠিক রাখতে সহায়তা করে। গাছপালা তথা বনভূমি বৃষ্টির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে ভূ- গর্ভস্থ পানি স্তরকে অপেক্ষাকৃত উপরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বনভূমি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য।আর কোন দেশের পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট আয়তনের ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশের মোট আয়তনের মাত্র১৭.৫১% বনভূমি রয়েছে। তাই বাংলাদেশের সরকার বনভূমির আয়তন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃক্ষরোপণ অভিযানের মাধ্যমে নতুন বন সৃষ্টি কার্যক্রম চালু করেছে। আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের গুরুত্ব আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।