অঞ্চল কাকে বলে-অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও উপাদান বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আপনি কি অঞ্চল কাকে বলে-অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও উপাদান সম্পর্কে জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা আজকের আর্টিকেলে অঞ্চল কাকে বলে-অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও উপাদান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।

অঞ্চল কাকে বলে-অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও উপাদান বর্ণনা কর
অঞ্চলের ভিত্তিতে পৃথিবীর সমীক্ষার ধারণাটি বেশ প্রাচীন। মূলত "অঞ্চল" হলো পৃথিবীকে বুঝার জন্য ভূগোলবিদদের একটি হাতিয়ার।

অঞ্চল কাকে বলে

অঞ্চল প্রত্যায়টি ভূগোলের (core-concept) হিসাবে আখ্যায়িত হয়ে আসছে।কেননা ভূগোলবিদগণই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ফলে সূত্রপাত ঘটে আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গির।"অঞ্চল" হচ্ছে একটি বৃহৎ ভূভাগ যা অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্নতর।সাধারণভাবে বলা যায়,অঞ্চল হলো একটি একক এলাকা এবং ঐ একক এলাকার মধ্যে এক ধরনের পারিসরিক সমরূপতা থাকে এবং এলাকাটি পার্শ্ববর্তী সব এলাকা থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র। সুতরাং এক কথায় বলা যায় যে, সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কোন স্বতন্ত্র ভৌগলিক এলাকাকে "অঞ্চল"বলে। বিভিন্ন ভূগোলবিদ অঞ্চলকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।নিম্নে প্রখ্যাত কয়েকজন ভূগোলবিদের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো-

অঞ্চলের সংজ্ঞা

পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে আঞ্চলিক ধারণা ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে বলে এর সার্বজনীন স্বীকৃত কোন সঠিক সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।বিভিন্ন পন্ডিতগণ অঞ্চলকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।তবে ভূগোলবিদগণ দীর্ঘদিন ধরে অঞ্চলের একটি যুক্তিপূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত সংজ্ঞা দানের চেষ্টা করে আসছেন।নিচে তাদের কিছু সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো:

১)G.R. Taylor (1879-1966) এর মতে, সমরূপ নিয়ামক বিশিষ্ট সামান্য বিস্তৃত ভূপৃষ্ঠের একটি একক এলাকাকে 'অঞ্চল' বলা হয়।অঞ্চলগুলোর সহজাত সামগ্রিকতা ও সামাজিক ঐক্য রয়েছে।

২)Robert,S.Platt (1891-1964) এর মতে, অঞ্চল বলতে এমন একটি ভৌগোলিক সীমারেখা কে বুঝায় যার নির্ধারিত ভূখণ্ড রয়েছে এবং সেই এলাকার অধিবাসী দের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ঐ অঞ্চল গড়ে উঠে।

৩)David B.Grigg (1934) অঞ্চল সম্পর্কে তার ধারণা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, "অঞ্চল হলো এমন একটি এলাকা যাকে কোন নির্দিষ্ট পরিচয়ে অন্য একটি এলাকা থেকে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে স্বতন্ত্র করা যায়"। আর এই স্বতন্ত্রতা যেমন-একটি একক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে হতে পারে তেমনিই একাধিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

৪)Richard Hartshorne (1939) এর মতে, আঞ্চলিক ভূগোলের লক্ষ্য হলো কোন একটি এলাকার পরস্পর সম্পর্কিত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পারিসরিক স্বতন্ত্রতা বা বৈষম্য প্রদর্শনের সব রকম জ্ঞানকে সংগঠিত করা"যার উপর ভিত্তি করে সমগ্র ভূপৃষ্ঠের শ্রেণী বিভাজন কাঠামো পদ্ধতি তৈরি করা যায়।"

৫)David Harvey (1935) অঞ্চলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,"অঞ্চল হলো ভূগোলের অন্যতম শ্রেণীর ধারণা এবং এটি ভৌগোলিক অধ্যয়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা মূলক এবং পদ্ধতিগত ভূমিকা পালন করে আসছে।

৬)K. Young এর মতে, অঞ্চল হচ্ছে একটি ভৌগোলিক এলাকা যার নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার মধ্যে ঐ এলাকার লোকদের চিন্তা ধারা, শিক্ষা, অবকাশ বিনোদন প্রভৃতিতে স্বাতন্ত্র্য রয়েছে এবং একটি এলাকা অন্য এলাকা থেকে পৃথক।

৭)Paul Vidal de la Blache এর মতে, "অঞ্চল এমন একটি জায়গা যেখানে বিভিন্ন সমাজের মানুষ এসে এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত জীবনযাত্রা গড়ে তোলে।"

৮)সাম্প্রতিককালে আমেরিকান সোসাইটি ফর প্লানিং থেকে ধারণা দেওয়া হয়েছে যে, অঞ্চল এমন স্থান যার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কাঠামো গড়ে উঠে।

অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য (characteristics of Regions)

প্রতিটি অঞ্চলের কতগুলো নির্দিষ্ট আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য থাকে যা দিয়ে ঐ অঞ্চলটিকে অন্য আরেকটি অঞ্চল থেকে পৃথক করা যায়।নিচে অঞ্চলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো:
  • এলাকাটি অবস্থানের দিক থেকে সমপ্রকৃতির এবং পার্শ্ববর্তী অবস্থা থেকে আলাদা হতে হবে। প্রত্যেক অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকবে।
  • কোন অঞ্চলের বর্তমান বৈশিষ্ট্য সাধারনত অতীতের উপর নির্ভরশীল। আর এই অতীত ঘটনা ঐতিহাসিক, পত্মতাত্ত্বিক ও ভূতাত্ত্বিক হতে পারে। পৃথিবীতে যেসব সামাজিক ও জৈবিক পরিবর্তন সাধিত হয় দেখা যায়, তার অধিকাংশই পরবর্তীকালে অঞ্চল সংক্রান্ত গবেষণার সূত্র যোগায় এবং অঞ্চলের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।
  • স্বতন্ত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার অঞ্চলের একটি থেকে অন্যটি পৃথকভাবে দেখানো হয়। ভূপৃষ্ঠের একটি স্থানের ভিত্তিতেও ঐ সব অঞ্চলের বিভাগ করা হয়।
  • এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য দ্বারা অঞ্চলের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় যা অন্য একটি অঞ্চলের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়।
  • একটি অঞ্চলকে এর শ্রেণীর অন্তর্নিহিত মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা হয়।
  • শ্রেণীবিভাগ অনুক্রমের মাধ্যমে অঞ্চলটি পৃথক একটি বিশেষ শ্রেণী হিসেবে নির্ধারিত হয়।
  • অঞ্চলের পারিসরিক সমরূপতা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
  • পারিসরিক উপাত্ত এবং তথ্যের উদ্দেশ্যমূলক সংগঠনের জন্য অঞ্চল একটি কাঠামো পরিবেশন করে।
  • একটি অঞ্চলের বিশেষ আয়তন, সীমানা ও অবস্থান থাকে, অবশ্য উক্ত উপাদান গুলোর সাধারণত কোন মানদণ্ড নেই।
  • অঞ্চল সৃষ্টি বা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ও মানবিক উভয় বৈশিষ্ট্যই ব্যবহৃত হতে পারে।

অঞ্চলের প্রকারভেদ

অঞ্চলকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় যেমন-
  • প্রাকৃতিক অঞ্চল
  • পর্যটন অঞ্চল
  • ঐতিহাসিক অঞ্চল
  • ধর্মীয় অঞ্চল
  • রাজনৈতিক অঞ্চল
  • প্রাকৃতিক সম্পদ অঞ্চল
  • সামরিক অঞ্চল

অঞ্চলের উপাদান

অঞ্চলের ধারণা থেকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, অঞ্চলের তিনটি উপাদান অবশ্যই থাকতে হবে। যেমন-

১) সীমানা (Boundary)

২) অবস্থান(Location)

৩) আয়তন (Area)

১)সীমানা (Boundary)

সীমানা অঞ্চলের একটি স্বাভাবিক উপাদান। কারণ আয়তন ও প্রকৃতি ভেদে ভিন্ন হলেও প্রত্যেক অঞ্চলেরই একটি নির্দিষ্ট সীমানা থাকে। যদিও সীমানার উপর অঞ্চলের আয়তন ও পরিসর নির্ভর করে। এছাড়াও একটি অঞ্চলকে সংজ্ঞায়িত করার উদ্দেশ্য যে রেখা দ্বারা সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিভিন্ন স্থানকে অন্যান্য স্থান থেকে পৃথক করা হয় সেই রেখাকে উক্ত অঞ্চলের সীমানা বলে।


উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,বরেন্দ্র ভূমি যদি বাংলাদেশের একটি অঞ্চল হয় তাহলে এর অবশ্যই সীমানা থাকতে হবে।বরেন্দ্র ভূমি বলতে এমন একটি এলাকাকে বুঝান হয়েছে যা রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত।

২)অবস্থান (Location)

নিঃসন্দেহে অঞ্চলে নিজস্ব অবস্থান রয়েছে।পৃথিবীতে অঞ্চলের অবস্থান শনাক্ত করণে জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে পারে। প্রায় ক্ষেত্রেই অঞ্চলের নাম তার অবস্থানকে সকলের দৃষ্টিগোচর করে।ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ইন্দোচীন শব্দটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে।


হৃদয় বৃত্তিকে নাড়া দিবার ক্ষমতা সম্পন্ন এটি সনির্বদ্ধ আবেদন যা এমন একটি এলাকাকে সনাক্ত করে যেখানে ভারত থেকে আগত সংস্কৃতি পরিপৃক্ত হয়েছে এবং চীন দেশ থেকে অভিগমনকারী মানুষের সংস্কৃতির মিলন সাধিত হয়েছে।ফলে ঐ বিশেষ ভূখণ্ডে ভারতীয় সংস্কৃতি ও চৈনিক সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে।

৩)আয়তন (Area)

প্রত্যেকটি অঞ্চলের নিজস্ব আয়তন রয়েছে। আবার অঞ্চলকে প্রণালী হিসাবেও ধারণ করা যেতে পারে। অনেক অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ একই বৈশিষ্ট্য দেখা না গেলেও বিশেষ কার্যকলাপ বা সম্ভবত এক প্রস্থ সমন্বিত কার্যকলাপ বিভিন্ন অংশকে একত্রিত করে যা একটি অঞ্চলে পরিণত করতে পারে।


বহুবিধ শিল্পের সমাবেশ ঢাকা নগরীর তেজগাঁও এলাকাটিকে একটি শিল্প অঞ্চল এ পরিণত করেছে।জাপানের ওসাকা,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টাবলয়, বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রভৃতি যে এলাকার কথাই বলা হোক না কেন একটি অঞ্চলের এলাকাভিত্তিক বা পারিসরিক ব্যাপ্তিকে কোন বিশেষ আধেয়র প্রসঙ্গ ছাড়া সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, অঞ্চলের ধারণা শুধুমাত্র বড় আকারের বিভাজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অধিকতর ক্ষুদ্র স্কেলেও অঞ্চলকে চিহ্নিত বা সংজ্ঞায়িত করা যায়। আজকের আর্টিকেলে অঞ্চল কাকে বলে-অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও উপাদান বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url