আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কী?-আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, নিয়ামক ও গুরুত্ব বর্ণনা কর।
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কী?। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।তাই আজকের আর্টিকেল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কী?-আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, নিয়ামক ও গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলতে বোঝায় এক দেশের সাথে অন্য দেশের পণ্য দ্রব্যের আদান-প্রদান করা।এ বাণিজ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে পণ্য-দ্রব্য আমদানি রপ্তানি প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়।
ভূমিকা
উৎপাদিত পণ্য (দ্রব্য ও সেবা) ক্রয়-বিক্রয় এবং আদান-প্রদান ও আনুষঙ্গিক কর্মকান্ডকে একত্রে বাণিজ্য বলে। বাণিজ্য হলো মানুষের তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত।এ ক্ষেত্রে মানুষের ভোগক্রিয়া সম্পাদনের জন্য পণ্য দ্রব্য ভোগকারীর কাছে পৌঁছানো হয়। প্রথমে অভ্যন্তরীণ বাজারে এবং পরে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করা হয়।যে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা যত বেশি সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ততো দ্রুত হয়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
এক দেশের সাথে অন্য দেশের পুঁজি,দ্রব্য ও সেবা বিনিময়ের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলে।সহজভাবে বলতে গেলে এক দেশের সাথে অন্য দেশের পণ্য দ্রব্যের আদা- প্রদান করা হলে তাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা বিশ্ব বাণিজ্য বলে। সাধারণত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে কোন দেশের উদ্বৃত্ত পণ্য চাহিদাপূর্ণ অন্য দেশে রপ্তানি এবং নিজের চাহিদাপূর্ণ পণ্য আমদানি করা হয়।
পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে সকল পণ্য পৃথিবীর সব জায়গাতে সমানভাবে পাওয়া যায় না।বর্তমান বিশ্বে কোন দেশ একক ভাবে তার প্রয়োজনীয় সব দ্রব্য উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজন হয়। চাহিদার বৈচিত্র্য বৃদ্ধির সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে পণ্য-দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমুদ্র বন্দর ও পোতাশ্রয় ব্যবহৃত হয়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রধান কৃষি পণ্য ও শিল্পজাত দ্রব্য আদান-প্রদান করা হয়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রধান কৃষি পণ্য, দেশীয় শিল্প ও সম্পদ রক্ষার্থে সরকার যেকোন বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরকার কর্তৃক শুল্ক ধার্য করা যায়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন বিধি-নিষেধ না থাকলে তাকে অবাধ বাণিজ্য বলে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রকারভেদ
সরকারি ভূমিকা বিবেচনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দুই প্রকার যথা:
১) অবাধ বাণিজ্য
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারি বাধা সমূহ আরোপ না করে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যকে অবাধ বাণিজ্য বলে।
২) সংরক্ষিত বাণিজ্য
ট্যারিফ,কোটা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ মূলক সংরক্ষণ নীতি দ্বারা সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বাণিজ্যকে সংরক্ষিত বাণিজ্য বলে।
*আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিশীলতার ভিত্তিতে একে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১) আমদানি বাণিজ্য
কোন দেশ তার প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ও সেবা অন্য কোন দেশ থেকে ক্রয় বা আনয়ন করলে তাকে আমদানি বাণিজ্য বলে।
২) রপ্তানি বাণিজ্য
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রম হলো রপ্তানি বাণিজ্য। উদ্বৃত্ত পণ্য ও সেবা অন্য দেশে বিক্রির মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্য সংঘটিত হয়।
৩)পূন: রপ্তানি বাণিজ্য
কাঁচামাল ও কলকব্জা আমদানির মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের শতভাগ অন্য দেশে বিক্রি করার সাথে যুক্ত কর্ম- কান্ডকে পূন: রপ্তানি বাণিজ্য বলে। এক্ষেত্রে রপ্তানির পূর্বে আমদানিকৃত পণ্যের উপর কোন শুল্ক আরোপ করা হয় না।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একপাক্ষিক অর্থাৎ দুটি দেশের মধ্যে এবং বহুপাক্ষিক বা কতিপয় দেশের মধ্যে সংঘটিত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়ামক সমূহ
যে সকল উপাদান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংঘটনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তা নিম্নরূপ:
১) প্রাকৃতিক উপাদান
২) জনসংখ্যা
৩) মূলধন
৪) দূরত্ব ও পরিবহন
৫) রাজনৈতিক উপাদান
৬) যোগান
৭) উদ্যোগ
৮) উন্নয়নের স্তর
৯) করনীতি
১)প্রাকৃতিক উপাদান:
ক) আয়তন ও প্রাকৃতিক সম্পদ: বৃহৎ আয়তনের দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ থাকে। ফলে উদ্বৃত্ত পণ্য সহজে রপ্তানি করতে পারে।যেমন:সৌদিআরব, রাশিয়া ইত্যাদি দেশ পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করে।
খ) অবস্থান: সমুদ্র বা জলপথে পণ্য পরিবহন সহজ বলে সমুদ্র বেষ্টিত বা উপকূলবর্তী দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য বেশি।যেমন: হংকং,সিঙ্গাপুর। অন্যদিকে আফগানিস্তান, ভুটান দূর্গম হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কম অংশগ্রহণ করতে পারে।
গ) ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু: বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত। তাই এখানে পাট, আখ, তামাক, চা ইত্যাদি বেশি জন্মে এবং রপ্তানি করতে পারে। অন্যদিকে সুইজারল্যান্ড পার্বত্য অঞ্চল হওয়ার কারণে সেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। যার ফলে শিল্পজাত পণ্য সহজে রপ্তানি করতে পারে।
২) জনসংখ্যা
ক) জনসংখ্যার আকার: কোন দেশের জনসংখ্যা অধিক হলে পণ্যের চাহিদা বেশি হয়,ফলে আমদানি করতে হয়। যেমন-বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান অন্যদিকে সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা কম হলে উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানি করা যায় যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশ।
খ) অভ্যাস ও পছন্দ: মানুষের অভ্যাস ও পছন্দের কারণেও বাণিজ্য প্রভাবিত হয়। যেমন- ইংল্যান্ড চা আমদানি করে এবং যুক্তরাষ্ট্র চকলেট আমদানি করে।
গ) ধর্মীয় বিধি-নিষেধ: ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কারণে ভারতে গো-মাংস এবং বাংলাদেশে মদ জাতীয় পণ্যের বাণিজ্য অত্যন্ত সীমিত।
ঘ) শ্রমিক সরবরাহ: শিক্ষার মান ও দক্ষতা বেশি থাকলে কোন দেশ উন্নত প্রযুক্তির পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করতে সক্ষম হয় যেমন- ইউরোপ ও আমেরিকা উচ্চ মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে।পক্ষান্তরে শিক্ষার মান ও দক্ষতার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ কম মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করতে সক্ষম হয়।
৩) মূলধন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধরন এবং পণ্য দ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণ উভয় ক্ষেত্রেই মূলধনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মূলধন বেশি থাকলে অধিক পরিমাণ ও গুণগত মান সম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করা যায় এবং সুলভ মূল্যে বাজারে ছাড়া যায়,এতে ক্রেতার আগ্রহ বেশি থাকে।
৪) দূরত্ব ও পরিবহন
দূরত্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম একটি প্রভাবক। একই মানের পণ্য কম দূরবর্তী স্থান থেকে আমদানি করা লাভজনক। কারণ এতে পরিবহন ব্যয় কম হয়। যেমন-বাংলাদেশ, জাপান অথবা জার্মানির পরিবর্তে ভারত থেকে গাড়ি আমদানি করে।
৫) রাজনৈতিক উপাদান
ক) রাজনৈতিক ভাবাদর্শ: রাজনৈতিক আদর্শগত মিলের কারণে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে প্রচুর বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। অপরদিকে কিউবা ও ভেনিজুয়েলা যুক্তরাষ্ট্রের নিকটবর্তী দেশ হওয়া সত্ত্বেও আদর্শগত পার্থক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য সীমিত।
খ) সরকারি নীতি: দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে অনেক সময় কোন দেশ কঠোর আমদানি নীতি গ্রহণ করে ফলে সেখানে আমদানি বাণিজ্য কম হয়। যেমন-ভারত নিম্নমানের নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করে তবু বিদেশি গাড়ি আমদানি করে না।
গ) আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি: শক্তিধর দেশসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক আগ্রাসী ভূমিকার কারণে বাণিজ্য প্রভাবিত হয়। যেমন-যুক্তরাষ্ট্রের ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত ইচ্ছা ও সুবিধা থাকা সত্ত্বেও ইরান থেকে তেল আমদানি করতে পারছে না। আবার দেখা যায় যে, যুদ্ধে সহযোগিতার বিনিময়ে কাতার লিবিয়া থেকে অবাধ তেল আমদানি করছে।
৬) যোগান
চাহিদা ও যোগানের সমন্বয় না হলে কখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্ভব হয় না।এছাড়াও দেখা যায় যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বিবেচনা করে বাংলাদেশে চাল রপ্তানি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
৭) উদ্যোগ
উদ্যোগের ওপর উৎপাদন নির্ভরশীল এবং উৎপাদনের ওপর বাণিজ্য নির্ভরশীল। ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো রপ্তানি বাজার খুঁজে বের করে ফলে বাণিজ্য ত্বরান্বিত হয়।উদ্যোগের ফলে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর মালয়েশিয়া তে বাংলাদেশ আবার জনশক্তি রপ্তানি করতে পারছে।
৮) উন্নয়নের স্তর
উন্নত দেশসমূহের আমদানি ও রপ্তানি উভয় বেশি।ফলে সেখানে ভারসাম্য থাকে। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশে আমদানি বেশি কিন্তু রপ্তানি কম ফলে সেখানে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করে।
৯) করনীতি/মুদ্রানীতি
করনীতি ও মুদ্রানীতি বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। অধিক হারে কর আরোপের ফলে আমদানি ও রপ্তানি ব্যয় বেড়ে যায় ফলে বাণিজ্য কমে যায়। আবার মুদ্রা মান কমলে রপ্তানি উৎসাহিত এবং মুদ্রা মান বাড়লে আমদানি উৎসাহিত হয়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অধিক। নিচে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো:
১) পণ্য দ্রব্যের আদান-প্রদান
কোন দেশ তার নিজের প্রয়োজনীয় সব দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে না।বহু পণ্যের জন্য তাকে অন্য সব দেশের মুখাপেক্ষী হতে হয়। নিজের দেশের উদ্বৃত্ত পণ্য সামগ্রী অন্য দেশে রপ্তানি এবং অন্য দেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যগুলো আমদানি করতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব অধিক।
২) অর্থনৈতিক উন্নয়ন
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্যের উপর। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছাড়া কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
৩) শিল্পোন্নয়ন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কলকব্জা ছাড়াও কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি এবং ম্যাঙ্গানিজ, টাংস্টেন, আকরিক লোহা প্রভৃতি খনিজ কাঁচামাল আমদানি এবং শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে শিল্পের উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়।
৪) কর্মসংস্থান
আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে আমদানি ও রপ্তানি কাজে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে, প্যাকিং শিল্পে, লাইসেন্সের মাধ্যমে পণ্য দ্রব্য বিদেশে প্রেরণ করা এবং লাইসেন্সের মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকার পণ্য আমদানিকরণ এবং সেগুলো নির্দিষ্ট চাহিদা পূর্ণ এলাকায় প্রেরণ করতে গিয়ে অর্থ বিনিয়োগ,পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় দৈহিক শ্রম কাজে লাগিয়ে বহু লোক নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।
৫) কৃষির উন্নয়ন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে বিদেশে দেশি কৃষি পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়। এছাড়াও বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জন্য চাহিদা পূরণ করতে পান, সুপারি, কচুর লতি থেকে শুরু করে আলু, বেগুন, ঝিঙ্গে প্রভৃতি তাজা সবজি এমনকি অপ্রচলিত তেঁতুলের বিচি প্রভৃতি কৃষি পণ্য পাঠাতে হয় বলে এই পণ্যের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের রপ্তানিকারক ও কৃষকগণ অধিক উপকৃত হন এবং অধিক পরিমাণে কৃষি দ্রব্য উৎপাদনে আগ্রহী হন, ফলে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৬) পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে বিদেশে পণ্য প্রেরণের জন্য এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহের জন্য সরকার দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি বিধান করেন। সড়ক পথ মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করা, অধিক প্রশস্ত করা,রেলপথ সম্প্রসারণ ও ডবল লাইন স্থাপনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ শহর, নগর,বন্দরগুলোর সাথে দ্বিমুখী যাত্রী ও পণ্য চলাচলের ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হয়।
৭) জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল, জাতির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। মানুষ বিভিন্ন মুখী সুযোগ গ্রহণ করে আর্থিক উন্নতির সাথে সাথে নিজের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারে। অবশ্য একই সাথে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নতির পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়।
৮) সামাজিক গুরুত্ব
বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সভ্যতা-সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয় এবং এর ফলে দেশের সামাজিক পরিবেশ উন্নত হয়। বিদেশের সাথে দেশের পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে ওঠার কারণ
যেকোনো দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে (ক)প্রাকৃতিক কারণ,(খ) অর্থনৈতিক কারণ এবং (গ) রাজনৈতিক কারণ (ঘ)সামাজিক কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(ক) প্রাকৃতিক কারণ
যে সকল দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে উঠে সে দেশগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্যতা, দেশগুলোর কৃষিজাত, খনিজ ও শিল্পজাত পণ্য দ্রব্যের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে।ফলে একটি দেশ কখনোই সব সম্পদে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে না। সেজন্য নিজেদের মধ্যে ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে উঠে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে উঠার পেছনে দুইটি প্রাকৃতিক কারণ উল্লেখযোগ্য:
(১) ভৌগলিক অবস্থান
কোন দেশের অক্ষাংশগত অবস্থানের কারণে দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সহায়ক হয়।জাপান,অস্ট্রেলিয়া,ভারত,যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে তোলার উপযুক্ত। অন্যদিকে মঙ্গোলিয়া, নেপাল, ভুটান প্রভৃতি দেশ মহাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ দ্বারা ঘেরা দেশগুলো বাণিজ্য উন্নতি লাভ করতে পারেনি।
(২) প্রাকৃতিক সম্পদের অসম বন্টন
- পৃথিবীর উষ্ণ মন্ডলে অবস্থিত দেশগুলোতে মূল্যবান শাল, সেগুন প্রভৃতি কাঠ পাওয়া যায়। তার বিপরীতে শীতপ্রধান মধ্য অক্ষাংশের দেশগুলোতে নরম কাঠের সরলবর্গীয় গাছ পাওয়া যায়।
- এই তারতম্যের কারণে উভয় দেশগুলোর মধ্যে কাঠের আদান-প্রদানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে উঠে।
- ভারত, সুরিনাম, গিয়ানা প্রভৃতি ক্রান্তীয় উষ্ণ মন্ডলের বৃষ্টিবহুল দেশে বক্সাইট সম্পদে সমৃদ্ধ।
- নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের দেশগুলো জাপান, নরওয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ে।
- মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচুর পেট্রোলিয়াম পাওয়া যায়।
- সম্পদের উপরোক্ত অসম বন্টনের কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে উঠে।
(খ) অর্থনৈতিক কারণ
- দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে।শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে শিল্পজাত দ্রব্য সামগ্রী রপ্তানি করা হয় এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয়।দেখা যায় জাপান ইস্পাত, যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী রপ্তানি করে এবং চীন ভারত প্রভৃতি দেশ থেকে লৌহ আক্ষরিক, কয়লা প্রভৃতি আমদানি করে। অনুরূপভাবে কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতেও সৃষ্ট কৃষিজাত দ্রব্য আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে উঠে।
- বৈদেশিক মূলধন বিনিয়োগ করে রপ্তানি বৃদ্ধি করা যায়, মধ্যপ্রাচ্য পেট্রোলিয়াম উৎপাদনের জন্য প্রচুর মার্কিন পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়েছে।এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে অন্যান্য দেশের পেট্রোলিয়াম বাণিজ্য গড়ে উঠেছে।
(গ) রাজনৈতিক কারণ
সরকারের নেওয়া নীতির উপর আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ নির্ভর করে।
দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা বিশ্বের একাধিক দেশ গুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করে। ভারত-রাশিয়া, ভারত-চীন, বাংলাদেশ-চীন, বাংলাদেশ-ভারত প্রভৃতি দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি গুলো দ্বারা উভয় দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক চুক্তি "গ্যাট"বাস্তবায়িত হওয়ার সমগ্র পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধরন পাল্টে গেছে। এছাড়াও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং মৈত্রী চুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
(ঘ) সামাজিক কারণ
- পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে খাদ্য, বস্ত্র এবং অন্যান্য শিল্পজাত সামগ্রী সাধারণ চাহিদা তুলনায় অনেক কম উৎপাদিত হয়। ফলে এই দেশগুলো বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করে। বাংলাদেশ চীন থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভারত ও মায়ানমার থেকে খাদ্যদ্রব্য, অস্ট্রেলিয়া থেকে গুঁড়ো দুধ প্রভৃতি আমদানি করে।
- অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে উৎপন্ন পোশাক, উপকূল এলাকায় উৎপাদিত চিংড়ি,কাঁকড়া, নদীর মোহনা থেকে ধরা ইলিশ মাছ বিদেশে রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অবদান রাখছে।
- প্রযুক্তিবিদ্যা,বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে দেশ যত উন্নত সেই দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাণিজ্য তত বেশি প্রসার লাভ করেছে। জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কম্পিউটার প্রযুক্তিতে উন্নত হওয়ায় দেশ দুটো কম্পিউটার রপ্তানি করে এবং রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, কামান প্রভৃতি সমরাস্ত্র বিশ্বের সর্বত্র রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সৃষ্টি করেছে।
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নতির সাথে সাথে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে আর এই পরিবহন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। জাপান শিল্প উন্নত দেশ হলেও দেশটি খনিজ সম্পদে তেমন সমৃদ্ধ নয় কিন্তু উন্নত ও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা থাকায় বিভিন্ন দেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি ও রপ্তানি করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়েছে।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, এক দেশের সাথে অন্য দেশের পুঁজি, দ্রব্য ও সেবা বিনিময়ের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলে।সুতরাং আজকের আর্টিকেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কি?-আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, নিয়ামক ও গুরুত্ব ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গড়ে ওঠার কারণ কি সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।