বাণিজ্য কাকে বলে-বাণিজ্যের প্রকারভেদ আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন বাণিজ্য কাকে বলে? বাণিজ্য হলো পণ্য দ্রব্য ও পরিসেবামূলক ক্রয়-বিক্রয় এবং আদান-প্রদানকে বুঝায়। আজকের আর্টিকেলে বাণিজ্য কাকে বলে-বাণিজ্যের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। অনুরোধ রইলো আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার।
প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবে মানুষের চাহিদার অন্ত নেই।মানুষের বৈচিত্র্যবহুল চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন পণ্য-দ্রব্য ও সেবা দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে আদান-প্রদান কে বাণিজ্য বলে।
বাণিজ্য কাকে বলে
উৎপাদিত পণ্য (দ্রব্য ও সেবা) ক্রয়-বিক্রয় এবং আদান-প্রদান ও আনুষঙ্গিক কর্মকান্ডকে একত্রে বাণিজ্য বলে। বাণিজ্য হলো মানুষের তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত।এ ক্ষেত্রে মানুষের ভোগক্রিয়া সম্পাদনের জন্য পণ্য দ্রব্য ভোগকারীর কাছে পৌঁছানো হয়। প্রথমে অভ্যন্তরীণ বাজারে এবং পরে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করা হয়।যে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা যত বেশি সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ততো দ্রুত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, বর্তমান যুগে উন্নত জীবন যাপনের অন্যতম প্রধান কারণ বাণিজ্য।
বাণিজ্যের প্রকারভেদ
পারিসরিক ব্যাপ্তি হিসেবে বাণিজ্য দুই ধরনের:
১) অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য
২) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
১) অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য
একই দেশের ভিতরে বিভিন্ন নদী বন্দর ও গঞ্জ এলাকা, ছোট-বড় হাট বা বাজারের মধ্যে পণ্য দ্রব্যের আদান-প্রদান হলে তাকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বলে। দেশের অভ্যন্তরে নদীর পাশে যে বন্দর গড়ে উঠে তাকে নদী বন্দর বলে। নদী বন্দর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয়। নদীপথে পরিবহন পথ সুলভতম হওয়ায় বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পণ্য আদান-প্রদান করা হয় নদীপথের মাধ্যমে।
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বিভিন্ন বাণিজ্যিক কেন্দ্র নির্ভর।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যই বিভিন্ন ব্যবস্থার প্রথা চালু করেছে।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য একটি অঞ্চলের উৎপাদিত দ্রব্য অন্য অঞ্চলের ভোক্তার কাছে সহজেই পৌঁছে দেয়।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বিভিন্ন ধাপে অর্থনীতিক অবকাঠামো রচনা করে।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে মূলত ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বিনিময় হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখানকার ক্রেতারা পরিবারের ব্যবহারের জন্য বেশিরভাগ সামগ্রীই কিনে থাকে।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রাথমিক ধাপে স্থানীয় পর্যায়ে বিনিময় হয়। পরে বিভিন্ন শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সেবা প্রদান করে।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ক্রমবর্ধমান চাহিদার ক্ষেত্রে বৃহত্তর আঞ্চলিক পর্যায়েও সেবা প্রদান করে।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের ভিতরের চাহিদা পূরণ শেষে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সৃষ্টি করে।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের দ্বারা দেশের এক অঞ্চলের মানুষের সাথে অন্য অঞ্চলের মানুষের সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অবাধ ও সুষ্ঠু হলে দেশের কৃষক, উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ই সুবিধা ভোগ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
এক দেশের সাথে অন্য দেশের পুঁজি,দ্রব্য ও সেবা বিনিময়ের সামগ্রিক ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলে।সহজভাবে বলতে গেলে এক দেশের সাথে অন্য দেশের পণ্য দ্রব্যের আদান-প্রদান করা হলে তাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা বিশ্ব বাণিজ্য বলে। সাধারণত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে কোন দেশের উদ্বৃত্ত পণ্য চাহিদাপূর্ণ অন্য দেশে রপ্তানি এবং নিজের চাহিদাপূর্ণ পণ্য আমদানি করা হয়। পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে সকল পণ্য পৃথিবীর সব জায়গাতে সমানভাবে পাওয়া যায় না।বর্তমান বিশ্বে কোন দেশ একক ভাবে তার প্রয়োজনীয় সব দ্রব্য উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজন হয়। চাহিদার বৈচিত্র্য বৃদ্ধির সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে পণ্য-দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সমুদ্র বন্দর ও পোতাশ্রয় ব্যবহৃত হয়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রধান কৃষি পণ্য ও শিল্পজাত দ্রব্য আদান-প্রদান করা হয়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রধান কৃষি পণ্য, দেশীয় শিল্প ও সম্পদ রক্ষার্থে সরকার যেকোন বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সরকার কর্তৃক শুল্ক ধার্য করা যায়।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন বিধি-নিষেধ না থাকলে তাকে অবাধ বাণিজ্য বলে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অধিক। নিচে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো:
১) পণ্য দ্রব্যের আদান-প্রদান
কোন দেশ তার নিজের প্রয়োজনীয় সব দ্রব্য উৎপাদন করতে পারে না।বহু পণ্যের জন্য তাকে অন্য সব দেশের মুখাপেক্ষী হতে হয়। নিজের দেশের উদ্বৃত্ত পণ্য সামগ্রী অন্য দেশে রপ্তানি এবং অন্য দেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যগুলো আমদানি করতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব অধিক।
২) অর্থনৈতিক উন্নয়ন
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্যের উপর। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছাড়া কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
৩) শিল্পোন্নয়ন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কলকব্জা ছাড়াও কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি এবং ম্যাঙ্গানিজ, টাংস্টেন, আকরিক লোহা প্রভৃতি খনিজ কাঁচামাল আমদানি এবং শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে শিল্পের উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়।
৪) কর্মসংস্থান
আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে আমদানি ও রপ্তানি কাজে বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে, প্যাকিং শিল্পে, লাইসেন্সের মাধ্যমে পণ্য দ্রব্য বিদেশে প্রেরণ করা এবং লাইসেন্সের মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকার পণ্য আমদানিকরণ এবং সেগুলো নির্দিষ্ট চাহিদা পূর্ণ এলাকায় প্রেরণ করতে গিয়ে অর্থ বিনিয়োগ,পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় দৈহিক শ্রম কাজে লাগিয়ে বহু লোক নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।
৫) কৃষির উন্নয়ন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে বিদেশে দেশি কৃষি পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়। এছাড়াও বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জন্য চাহিদা পূরণ করতে পান, সুপারি, কচুর লতি থেকে শুরু করে আলু, বেগুন, ঝিঙ্গে প্রভৃতি তাজা সবজি এমনকি অপ্রচলিত তেঁতুলের বিচি প্রভৃতি কৃষি পণ্য পাঠাতে হয় বলে এই পণ্যের চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের রপ্তানিকারক ও কৃষকগণ অধিক উপকৃত হন এবং অধিক পরিমাণে কৃষি দ্রব্য উৎপাদনে আগ্রহী হন, ফলে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৬) পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে বিদেশে পণ্য প্রেরণের জন্য এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহের জন্য সরকার দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি বিধান করেন। সড়ক পথ মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করা, অধিক প্রশস্ত করা,রেলপথ সম্প্রসারণ ও ডবল লাইন স্থাপনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ শহর, নগর,বন্দরগুলোর সাথে দ্বিমুখী যাত্রী ও পণ্য চলাচলের ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হয়।
৭) জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল, জাতির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। মানুষ বিভিন্ন মুখী সুযোগ গ্রহণ করে আর্থিক উন্নতির সাথে সাথে নিজের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারে। অবশ্য একই সাথে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নতির পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়।
৮) সামাজিক গুরুত্ব
বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যবসা এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সভ্যতা-সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয় এবং এর ফলে দেশের সামাজিক পরিবেশ উন্নত হয়। বিদেশের সাথে দেশের পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হলো বাণিজ্য।বাণিজ্য ছাড়া কোন দেশ উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই বাণিজ্যিক সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।কোন দেশের আমদানি ও রপ্তানি মূল্য সমান হলে সে দেশের বাণিজ্যের ভারসাম্য সমান থাকে।আজকের আর্টিকেলে বাণিজ্য কাকে বলে-বাণিজ্যের প্রকারভেদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।