ঘনীভবন কাকে বলে-ঘনীভবনের নিয়ামক সমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে ঘনীভবন কাকে বলে-ঘনীভবনের নিয়ামক সমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
পানি বাষ্পীয় অবস্থা থেকে তরল অথবা কঠিন অবস্থায় রূপান্তরিত হলে তাকে ঘনীভবন বলে। ঘনীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হলো বায়ুতে অতি সূক্ষ্ম কঠিন বস্তুকণা অথবা এরোসল উপস্থিত থাকা।
ভূমিকা
বায়ুমন্ডলে ভাসমান পানি কণার বা বরফ কণার রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ঘনীভবন বলে। বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও শীতলতার পরিমানের উপর ঘনীভবন নির্ভর করে।বায়ুর তাপমাত্রা শিশিরাঙ্কের বা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেলে ঐ তাপে বাতাসের জলীয়বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এই অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প, পানি কণা ও বরফ কণা হিসাবে ঘনীভূত হয়। ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় মেঘ, বৃষ্টি কণা, তুষার কণা প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।
ঘনীভবন
পানি বাষ্পীয় অবস্থা থেকে তরল অথবা কঠিন অবস্থায় রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ঘনীভবন (Condensation) বলে।এখানে ঘনীভবন হল বাষ্পীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়া। ঘনীভবন নির্ভর করে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও শীতলীকরন প্রক্রিয়ার উপর। আপেক্ষিক আদ্রর্তার পরিমাণ ১০০% হলে সেই বায়ুকে সম্পৃক্ত বলে গণ্য করা হয়।
এছাড়াও যে তাপমাত্রার বায়ু সম্পৃক্ত হয় তাকে বলা হয় শিশিরাংক। বায়ু সম্পৃক্ত হয়ে থাকে দুইটি প্রক্রিয়ায় যেমন-(১) নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় চরম আর্দ্রতা যখন বায়ুর আর্দ্রতায় ধারণ ক্ষমতার সমান পর্যায়ে আসে। (২) তাপমাত্রা হ্রাস পেয়ে এমন পর্যায় আসে যাতে আর্দ্রতার ধারণ ক্ষমতা পরম আর্দ্রতায় সমপর্যায়ে আসে।
তবে ঘনীভবন তখনই সংঘটিত হবে যখন বাতাস অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত হবে (Super satarated) এবং পনু: শীতলীকরনের পর আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১০০% অতিক্রম করে। তাপমাত্রা শিশিরাংকে পৌঁছালে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ ১০০% হয় এবং বায়ু সম্পৃক্ত হয়। এ অবস্থায় তাপমাত্রা শিশিরাংকের নিচে নামলে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প তরল অথবা কঠিন আকারে ঘনীভূত হয়।
আরো পড়ুন:জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহ কী?-জেট প্রবাহের বৈশিষ্ট্য, শ্রেণীবিভাগ ও জলবায়ুর উপর প্রভাব বর্ণনা কর।
যদি শিশিরাংক হিমাংকের উপরে থাকে (৩২°ফা. অথবা ০° সে.) তবে তরল এবং যদি শিশিরাংক হিমাংকের নিচে থাকে (০°সে. এর নিচে) তবে কঠিন আকারে ঘনীভবন সংগঠিত হবে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ৩২°ফা.-০°সে. এর নিচে কঠিন ঘনীভবন (শিলা, বরফ কুন্ডু ইত্যাদি) সংগঠিত হয় না-ঘনীভবন তরল আকারেই থাকে।কেলাসনের জন্য প্রয়োজনীয় কণা না থাকার জন্য এরূপ অবস্থা হয়।
ঘনীভবনের প্রভাবক
বায়ুতে ভাসমান কিছু সূক্ষ বস্তুকে আশ্রয় করে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়। বস্তুগুলিকে ঘনীভবন কনা বা পানি আকর্ষী কনা বলা হয়। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানিকনার বাষ্পীয় চাপ অনেক বেশি হওয়াতে তা ঘনীভূত হওয়ার আগে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। বিশুদ্ধ জলীয় বাষ্প শিশিরাংকের নিচে শীতল হলেও ঘনীভবন হয় না। সেক্ষেত্রে লবণ কণা, ধূলিকনা,ধোঁয়া বা সালফার-ডাই-অক্সাইডের সংযোগে হয়। এক্ষেত্রে বায়ু সহজে সম্পৃক্ত ও ঘনীভূত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জলীয় বাষ্পে লবণ কণা থাকলে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১০০% এ পৌঁছানোর আগেই তা' সম্পৃক্ত হতে পারে।
ঘনীভবনের বৈশিষ্ট্য
- ঘনীভবন হল গ্যাসীয় পদার্থের অবস্থাকে তরল পর্যায়ে পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া।
- ঘনীভবন হল বাষ্পীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়া।
- ঘনীভবন প্রায় পানিচক্রের মধ্যে দেখা যায়।
- ঘনীভবন ঘটে যখন জলীয়বাষ্পের অনুগুলি ঠান্ডা হয় এবং তরল পানি হিসেবে একত্রিত হয়।
- ঘনীভবন ঘটে যখন উষ্ণ বায়ু শীতল বা ঠান্ডা পৃষ্টের সাথে সংঘর্ষ হয়।
- ঘনীভবন নির্ভর করে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও শীতলীকরণ প্রক্রিয়ার উপর।
- ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় মেঘ, বৃষ্টি কণা, তুষারকণা প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।
- ঘনীভবনের সময় নির্গত তাপকে লীনতাপ বলা হয়।।
- ঘনীভবনের বিভিন্ন প্রকরণ রয়েছে যেমন:নোভেইনজেল ঘনীভবন,ক্লাইসেন ঘনীভবন,অ্যালডল ঘনীভবন ইত্যাদি।
ঘনীভবনের নিয়ামক
ঘনীভবনের নিয়ামক প্রধানত তিনটি যেমন:
১) আপেক্ষিক আর্দ্রতা: আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১০০% না হলে ঘনীভবনের পরিবেশ তৈরি হয় না।
২) শীতলীকরনের পরিমান: তাপ ও চাপ হ্রাস অথবা আয়তন বৃদ্ধির মাধ্যমে বায়ু শীতলীকরনের যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হয়।
৩) পানি আকর্ষী কণার উপস্থিতি: বায়ুতে ভাসমান পানি আকর্ষী কণাকে আশ্রয় করে জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়। কণার পরিমান ঘনীভবন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
ঘনীভবনের শ্রেণীবিভাগ
ঘনীভবনকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যেমন-(১) ভূপৃষ্ঠের সন্নিকটে ঘনীভবন (২) উর্ধ্বাকাশে ঘনীভবন
১) ভূ-পৃষ্ঠের সন্নিকটে ঘনীভবন
ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুর উষ্ণতা শিশিরাঙ্ক তাপমাত্রায় নেমে এলে ঘনীভবন সংঘটিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় বৃষ্টিপাত হয় না। এ পর্যায়ে যে ঘনীভবন গুলো সৃষ্টি হয় তা হলো- শিশির, তুহিন, কুয়াশা ইত্যাদি।
২)উর্ধ্বাকাশে ঘনীভবন
"Condensation aloft"সেই প্রক্রিয়াকে বোঝায় যেখানে বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প উচ্চতর থেকে উচ্চতায় তরল পানি বরফের কনাতে পরিণত হয়। আর এই বরফ কণায় পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে উর্ধ্বাকাশে ঘনীভবন বলে। এটা সাধারণত ঘটে যখন আর্দ্র বায়ু বৃদ্ধি পায় এবং সেটা শিশির বিন্দুতে শীতল প্রাপ্ত হয় এবং জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হতে শুরু করে।এই প্রক্রিয়ায় মেঘ ও বৃষ্টি পাত সংঘটিত হয়।
ঘনীভবন প্রক্রিয়া
ঘনীভবন সংঘটিত হয় জলীয়বাষ্পপূর্ণ (আর্দ্র) বায়ুর সম্পৃক্তকরণ,উর্দ্ধগমন ও শীতলীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ক্রিয়াটি বিভিন্নভাবে সংগঠিত হতে পারে। ঘনীভবনের প্রক্রিয়াসমূহ নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়:
১)রুদ্ধ তাপ হ্রাস বহির্ভূত বা সাধারণ পদ্ধতি
ক) পরিচলন পদ্ধতি: বায়ুর আনুভূমিক সঞ্চালনের দুইটি ভিন্ন তাপমাত্রার বায়ুপুঞ্জের মিশ্রনে পরিচলন পদ্ধতিতে শীতলীকরন হয়ে থাকে।
খ) বিকিরন পদ্ধতি:আর্দ্র বায়ু থেকে সরাসরি বিকিরনের মাধ্যমে বায়ুশীতলীকরনের প্রক্রিয়াকে বিকিরন পদ্ধতিতে শীতলীকরন বলা হয়।
গ) স্পর্শ পদ্ধতি: শীতল বায়ু স্তরের সংস্পর্শে উষ্ণ বায়ু শীতলীকরন প্রক্রিয়াকে বলে স্পর্শ পদ্ধতিতে শীতলীকরণ।
২)রুদ্ধ তাপ হ্রাস পদ্ধতি
রুদ্ধ তাপ হ্রাস পদ্ধতি বলতে বায়ুর সম্প্রসারনজনিত তাপমাত্রা হ্রাসকে বুঝায় যা' মূলত তিনটি পদ্ধতিতে সমাধান হয় যেমন-
ক) যান্ত্রিক উর্দ্ধগমন
খ)গতীয় উর্দ্ধগমন
গ) ঘূর্নীয় উর্দ্ধগমন
সাধারণত: প্রতি ১০০০ মিটার উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা ১০০০ ফুট উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ৩.৬° ফারেনহাইট তাপমাত্রা হ্রাস হয়। বায়ুর তাপমাত্রার এই উলম্ব হ্রাসকে স্বাভাবিক হ্রাস হার অথবা আদর্শ হ্রাস হার বলে। নির্দিষ্ট পরিমাণ বায়ু উর্দ্ধগমনের ফলে তাপমাত্রা হ্রাসের কারণে শীতলতা প্রাপ্ত হয়।
৩)নিম্ন বায়ু ঘনীভবন
নিম্ন বায়ু ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি হয় না-কুয়াশা, পানি কণা অথবা শিশিরাংক সংঘঠিত হতে পারে।
৪) উর্দ্ধবায়ু ঘনীভবন
রুদ্ধতাপ হ্রাস হারকে উর্দ্ধবায়ু ঘনীভবন বলা হয়। এই পদ্ধতিতে বায়ু উপরে ওঠার সময় অথবা নামার সময় তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটে। উপরের দিকে বায়ুর তাপ কম থাকায় বায়ু ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়ে তাপমাত্রা হ্রাস পায় কিন্তু নিম্নদিকে অবনমিত হলে অধিক চাপে বায়ু সংকুচিত হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে যায়।এই প্রক্রিয়ায় ভৌত গুণাবলীর কারণে তাপমাত্রার পরিবর্তনকে রুদ্ধতাপ পরিবর্তন বলা হয়।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে,বায়ুমন্ডলে ভাসমান পানি কণার বা বরফ কণার রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ঘনীভবন বলে। সুতরাং আজকের আর্টিকেলে ঘনীভবন কাকে বলে-ঘনীভবনের নিয়ামক সমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।