কুয়াশা বলতে কি বুঝ-শ্রেণীবিভাগসহ বিভিন্ন প্রকার কুয়াশার বর্ণনা দাও।

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন কুয়াশা বলতে কি বুঝায়।মূলত ভূ-পৃষ্ঠের নিকটবর্তী ভাসমান স্তর মেঘের মত জল কনাকে কুয়াশা বলে। আজকের আর্টিকেলে কুয়াশা বলতে কি বুঝ-শ্রেণীবিভাগসহ বিভিন্ন প্রকার কুয়াশার বর্ণনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা চেষ্টা করব।তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
কুয়াশা বলতে কি বুঝ-শ্রেণীবিভাগসহ বিভিন্ন প্রকার কুয়াশার বর্ণনা দাও।
দৃশ্যমানতার ভিত্তিতে চার ধরনের কুয়াশা সনাক্ত করা যায় যেমন: হালকা কুয়াশা, মধ্যম কুয়াশা, পুরু কুয়াশা, ঘন কুয়াশা।নিম্নে কুয়াশা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো:

ভূমিকা 

শীতকালে ঠান্ডা ভূ-পৃষ্ঠের সংস্পর্শে নিম্ন বায়ুস্তরের তাপমাত্রা হ্রাস পায়।ফলে বায়ুর জলীয়বাষ্প ভাসমান ধূলিকণাকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণারূপে ঘনীভূত হয় এবং ভূপৃষ্ঠের ওপর ধোঁয়ার ন্যায় ভাসমান অবস্থায় থাকে। একে কুয়াশা (Fog) বলে। পরিবেশ ও মানব জীবনের উপর কুয়াশা ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।নিম্নে কুয়াশা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো:

কুয়াশা

ভূ-পৃষ্ঠের নিকটবর্তী ভাসমান স্তর মেঘের মত জল কনাকে কুয়াশা (Fog)বলে। ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুর তাপমাত্রা বিভিন্ন কারণে শিশিরাঙ্কে পৌঁছালে বায়ুস্থ জলীয় বাষ্প ধূলিকনা,ধোয়া,লবণকনা ইত্যাদিকে আশ্রয় করে ঘনীভূত হয়ে জলকনায় পরিণত হয় এবং ঝুলন্ত অবস্থায় ভূমি সংলগ্ন হয়ে ভাসতে থাকে যা' কুয়াশা নামে পরিচিত।


"A Fog is nothing more than a cloud that touching the ground.lts appearence is as a stratus cloud"অর্থাৎ কুয়াশা মেঘের চাইতে বেশি কিছু নয় যা' ভূমিতলকে স্পর্শ করে। এর আকার স্তরীভূত মেঘের ন্যায়। সহজ কথায়, ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুস্তরে জলাাকর্ষী কণাকে আশ্রয় করে যে ঘনীভবন হয় তাকে কুয়াশা বলে।
জলবায়ু বিজ্ঞানী Byers এর ভাষায়"কুয়াশা হল অতি ক্ষুদ্র পানিবিন্দু যা'নিম্ন বায়ুমন্ডলে দৃশ্যমানতা হ্রাস করে।

কুয়াশার বৈশিষ্ট্য

১)কুয়াশা অনেক সময় ২০° ফা. তাপমাত্রায় Super cooled water থাকে যা'পরবর্তীতে বরফে পরিণত হয়।

২) কুয়াশার কনা ১ মিলিমিটারের ১/১০ ভাগ হতে ১/১০০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।

৩) কুয়াশার কনা আনুভূমিক দৃশ্যমানতা কমিয়ে দেয়।কুয়াশার কনা যত ক্ষুদ্র ও ঘন হবে দৃশ্যমানতা ততই কমতে থাকবে।

৪) কুয়াশার কনা বড় হতে থাকলে এ থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সৃষ্টি হয় একে drizzle বলে। কুয়াশার কনা ক্ষুদ্র ও অসংখ্য হলে এটা mist hage বা কুজ্ঝটিকায় পরিণত হয়।

৫) কুয়াশার কনাগুলো অনেক সময় ঘূর্ণনরত অবস্থায় দেখা যায়।

৬) কুয়াশার মধ্যকার বায়ু স্যাঁতস্যাঁতে মনে হয়।

৭) সূর্য উঠার পরে কুয়াশা দূরিভূত হতে থাকে। অনেক সময় নিচের দিকের কুয়াশা মিলিয়ে ঘাসের উপর বা গাছের ডালে এবং উপরের দিকেও কুয়াশা টিকে থাকে।

৮) কুয়াশা ভূ-পৃষ্ঠের বিকীর্ন তাপকেও শোষণ করে।ফলে বায়ু উষ্ণ থাকে, মাটিতে তুষার সঞ্চিত হতে পারে না।

৯) কুয়াশা যানবাহন, জাহাজ ও বিমান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।

১০) বাতাসের আপেক্ষিক আদ্রতা ৯৭% অতিক্রম করলে কুয়াশা সৃষ্টি হতে পারে।

কুয়াশা সৃষ্টির কারণ

ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন অংশে কুয়াশা সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কারণগুলি অত্যন্ত কার্যকরি:

১) বায়ুস্থ তাপমাত্রা শিশিরাঙ্কের নিচে নেমে গেলে কুয়াশার সৃষ্টি হতে পারে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে বায়ুর আপেক্ষিক আদ্রতা ১০০% হওয়ার পূর্বেই কুয়াশা সৃষ্টি হয়।

২) বায়ুমন্ডলে তাপীয় বিকিরণ, পরিবহন এবং শীতল ও উষ্ণ বায়ুর সংমিশ্রণের ফলে কুয়াশা সৃষ্টি হয়।

৩) জলীয় বাষ্পপূর্ন বায়ু কোন শীতল বায়ুর সংস্পর্শে আসলে কুয়াশার সৃষ্টি হয়।

৪) কলকারখানা বহুল অঞ্চলে ধোঁয়া, ধূলিকনা প্রভৃতি জলীয়বাষ্পের সাথে সংমিশ্রিত অবস্থায় ঘনীভূত হয়ে কুয়াশার সৃষ্টি করে।

কুয়াশার শ্রেণীবিভাগ

উৎপত্তিগত কারণের উপর ভিত্তি করে কুয়াশাকে প্রধানত দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।
১)আন্ত:বায়ুপুঞ্জ কুয়াশা
২) বায়ুপ্রাচীর জনিত কুয়াশা

১)আন্ত:বায়ুপুঞ্জ কুয়াশা

জলীয় বাষ্পের তাপমাত্রা হ্রাস পাবার ফলে যে কুয়াশা সৃষ্টি হয় তাকে আন্ত:বায়ুপুঞ্জ কুয়াশা বলে।আন্ত:বায়ুপুঞ্জ কুয়াশাকে আবার কতিপয় উপভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:

ক) বিকিরন জাত কুয়াশা
খ) আনুভূমিক সঞ্চালন কুয়াশা
গ) সঞ্চালন বিকিরন কুয়াশা
ঘ) উপরিঢাল কুয়াশা
ঙ) মিশ্র কুয়াশা
চ) ব্যারোমেট্রিক কুয়াশা

ক)বিকিরনজাত কুয়াশা

শীতল ভূপৃষ্ঠের সংস্পর্শে এসে ভূমি সংলগ্ন আর্দ্র বায়ু শীতল হয়ে যে কুয়াশা সৃষ্টি করে তাই বিকিরনজনিত কুয়াশা (Radiation fog) বলে।

খ)আনুভূমিক সঞ্চালন কুয়াশা

উষ্ণ আর্দ্র বায়ু শীতল ভূ-পৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে তাপীয় বিকিরনের মাধ্যমে তা ক্রমশ শীতল হয়ে আনুভূমিক সঞ্চালন (Advection) কুয়াশা সৃষ্টি করে।এ কুয়াশা বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।

গ)সঞ্চালন বিকিরন কুয়াশা

যখন বায়ুর আনুভূমিক সঞ্চালন ও বিকিরন উভয়ই উপস্থিত থাকে তখন যে কুয়াশা হয় তাকে আনুভূমিক সঞ্চালন বিকিরন(Advection -Radiation)কুয়াশা বলে।

ঘ)উপরিঢাল কুয়াশা

পর্বতের উপরের ঢাল বরাবর জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু প্রবাহিত হলে তা ক্রমশ উপরে উঠে শীতল ও প্রসারিত এবং সম্পৃক্ত হয়ে যে কুয়াশা সৃষ্টি করে তাকে উপরিঢাল কুয়াশা বলে।

ঙ)মিশ্র কুয়াশা

উষ্ণ আর্দ্র ও শীতল আর্দ্র বায়ু পরস্পর মিলিত হলে এদের মিলিত স্থানে উষ্ণতা কমে গিয়ে বায়ু সম্পৃক্ত ও ঘনীভূত হয়ে মিশ্র কুয়াশা সৃষ্টি করে। অতি ক্ষুদ্র পরিসরে এ ধরনের কুয়াশা দেখা যায়।

চ)ব্যারোমেট্রিক কুয়াশা

ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন আর্দ্র বায়ুতে হঠাৎ নিম্ন চাপের সৃষ্টি হলে আর্দ্র বায়ু ভূ-পৃষ্ঠ থেকে রুদ্ধতাপ হ্রাসের মাধ্যমে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে যে কুয়াশা সৃষ্টি হয় তাকে ব্যারোমেট্রিক কুয়াশা বলে।

২) বায়ু প্রাচীর জনিত কুয়াশা

ভিন্নতাপ ও আর্দ্রতা বিশিষ্ট দুইটি বায়ুপুঞ্জ পরস্পর মিলিত হলে উষ্ণ বায়ুপুঞ্জ উপরে উঠে সম্প্রসারিত, শীতল ও ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়।এক্ষেত্রে নিম্ন ভাগে অবস্থানরত শীতল বায়ুপুঞ্জটিতে অধিক জলীয় বাষ্প সংযোজিত হয়ে শীতল ও ঘনীভূত হলে বায়ুপ্রাচীর জনিত কুয়াশার সৃষ্টি হয়।

কুয়াশার বন্টন

সাধারণত স্থলভাগের চেয়ে সমুদ্রেই কুয়াশার ব্যাপকতা বেশি থাকে। নিম্ন অক্ষাংশ এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রের পূর্ব দিকের অপেক্ষাকৃত শীতল সমুদ্রস্রোত অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ এবং ব্যাপক কুয়াশা অঞ্চল। মধ্য অক্ষাংশ অঞ্চলে সৃষ্ট সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের উষ্ণ ক্রান্তীয় বায়ু মেরুর দিকে প্রবাহিত হলে কুয়াশার সৃষ্টি হয়।


উত্তর আটলান্টিকের পূর্ব দিকে, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের অ্যালিউশ্যান দ্বীপপুঞ্জ এবং আলাস্কা উপ সাগরে এ ধরনের কুয়াশা দেখা যায়।এছাড়া উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন স্থলে যেমন-নিউ ফাউন্ডল্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, জাপানের উত্তর-পূর্ব এলাকায়, ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রভৃতি স্থানে কুয়াশার সৃষ্টি হয়।


সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে মহাদেশ অপেক্ষা কুয়াশার প্রকোপ বেশি দেখা যায়। আবার শীতকালে স্থলভাগে এবং গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের মধ্যে কুয়াশার ব্যাপকতা বেশি হয়। এছাড়া মধ্য ও উচ্চ অক্ষাংশ অপেক্ষা নিম্ন অক্ষাংশের জল ও স্থল ভাগে কম কুয়াশা বিদ্যমান থাকে। তবে মধ্য ও উচ্চ অক্ষাংশে প্রধানত:গ্রীষ্মকালেই কুয়াশার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

কুয়াশার প্রভাব/ফলাফল

কুয়াশা ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি সংঘটিত হওয়ার কারণে মানব জীবনের উপরে এর প্রভাব সরাসরি পড়ে। মানব জীবনে কুয়াশার প্রভাবকে তিন ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

১) কৃষি/ফসল উৎপাদনের ওপর প্রভাব
২) যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর প্রভাব
৩) স্বাস্থ্যগত প্রভাব

১) কৃষির ওপর প্রভাব

কুয়াশার কারণে শীতকালীন ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। এছাড়াও অত্যাধিক কুয়াশার ফলে আম, সরিষা ইত্যাদির মুকুল নষ্ট হয়ে উৎপাদন হ্রাস পায়।

২) যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর প্রভাব

সড়ক,নৌ ও বিমান যোগাযোগ কুয়াশার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়।কুয়াশার কারণে সড়কে গতি কমে যায় এবং দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও বিমান উড্রয়ন ও অবতরণ করতে পারে না।নদীপথে ফেরী, লঞ্চ ইত্যাদি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।

৩) স্বাস্থ্যগত প্রভাব

বিশেষত শহরাঞ্চলের বায়ুমণ্ডলের ধূলিকনা, ধোয়া ইত্যাদি কুয়াশার সাথে মিশ্রিত হয়ে ধোঁয়াশা গঠন করে এবং কুয়াশা দীর্ঘস্থায়ী হয়। যার ফলে এলার্জি, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশি সহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়। এছাড়াও কুয়াশার কারণে দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়।

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ভূ-পৃষ্ঠের নিকটবর্তী ভাসমান স্তর মেঘের মত জল কনাকে কুয়াশা বলে।আজকের আর্টিকেলে কুয়াশা বলতে কি বুঝ-শ্রেণীবিভাগসহ বিভিন্ন প্রকার কুয়াশার বর্ণনা দাও এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশাকরি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url