জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহ কী?-জেট প্রবাহের বৈশিষ্ট্য, শ্রেণীবিভাগ ও জলবায়ুর উপর প্রভাব বর্ণনা কর।
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহ কী? আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।তাই আজকের আর্টিকেলে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহ কী?-জেট প্রবাহের বৈশিষ্ট্য, শ্রেণীবিভাগ ও জলবায়ুর উপর প্রভাব।তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
জেট বায়ুপ্রবাহ অন্যান্য বায়ুমণ্ডলীয় প্রবাহ থেকে অনেক টাই ভিন্নতর।সাধারণভাবে জেট প্রবাহ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়।Barry এবং Chorley মতে, জেট বায়প্রবাহকে ঊর্ধ্ব জিওট্রফিক বায়ুপ্রবাহ বলে অভিহিত করেন।
ভূমিকা
জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহ ঊর্ধ্ব ট্রোপোস্ফিয়ারের সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা দ্রুত গতি সম্পন্ন বায়ুপ্রবাহ।জেট স্ট্রীম তুলনা মূলক সংকীর্ণ পথে প্রবাহিত শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ যা'কম গতিসম্পন্ন বায়ুপ্রবাহ দ্বারা বেষ্টিত থাকে।জেট স্ট্রীমকে পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ হিসেবে বর্ণনা করা যায় যা' সংকীর্ণ পরিসরে হাজার হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, কয়েকশো কিলোমিটার প্রস্থ এবং দুই বা ততোধিক কিলোমিটার উলম্ব পুরুত্ব নিয়ে বিরাজমান। এই বায়ু চক্রাকারে এবং নিয়মিত প্রবাহিত হয়।
জেট প্রবাহ
জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহ হচ্ছে ঊর্ধ্ব ট্রোপোস্ফিয়ারের সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা দ্রুতগতি সম্পন্ন বায়ুপ্রবাহ। জলবায়ু বিজ্ঞানে এটা নবীনতম সংযোজন বা আবিষ্কার।এই বায়ু প্রবাহটির নামকরণ এবং আবিষ্কার ঊনিশ'শ চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে।ঐ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেট জঙ্গি বিমান গুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে (যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপান) যাওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে (অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে) অত্যন্ত শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হত।
আবার পশ্চিম থেকে পূর্বে আসার সময় দ্রুত গতিতে ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তন করতে পারত।বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আবিষ্কার করা হয় ঊর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারের সংকীর্ণ বাঁক বিশিষ্ট দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি নিয়মিত বায়ুপ্রবাহ যা' জেট বিমানগুলির স্বাভাবিক গতিপথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও পশ্চিম থেকে পূর্বে নিয়ত প্রবাহমান এই শক্তিশালী উর্ধ্ব ট্রপোস্ফিয়ারের বায়ুপ্রবাহটি ঐ সময় থেকে জেট স্ট্রীম নামে আখ্যা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বায়ু প্রবাহটি নিয়ে আরো গবেষণার মাধ্যমে এর বৈশিষ্ট্য ও জলবায়ুগত প্রবাহ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জ্ঞাত হন।
জেট প্রবাহের বৈশিষ্ট্য
জেট বায়ুপ্রবাহ অন্যান্য বায়ুমণ্ডলীয় প্রবাহ থেকে ভিন্নতর।এই বায়ুপ্রবাহ সম্পর্কে গবেষণা ও নিরীক্ষা পর্যাপ্ত নয়।Critchfield,Trewartha,Barry প্রমুখ জলবায়ু বিজ্ঞানীরা জেট প্রবাহের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ সনাক্ত করেন:
১) সাধারণভাবে জেট প্রবাহ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। তবে গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত একটি কম গতিসম্পন্ন পূবালী জেট প্রবাহ সৃষ্টি হয়। তবে দক্ষিণ গোলার্ধে এ ধরনের পূবালী জেটের অস্তিত্ব নেই।
২)এর বিস্তার কয়েকশ কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্য হাজার হাজার কিলোমিটার হতে পারে।গভীরতা ৭.৫-১৪ কি.মি এর মধ্যে।
৩) জেট প্রবাহের গতিপথ তরঙ্গায়িত ও আঁকাবাঁকা।
৪) সাধারণভাবে জেট প্রবাহের অস্তিত্ব উভয় গোলার্ধে ২০° অক্ষাংশ হতে মেরুর মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত পর্যবেক্ষিত হয়। এটি অনেক সময় মেরু প্রদক্ষিণকারী প্রবাহ হিসেবে আখ্যায়িত হয়-কারণ উভয় গোলার্ধে মেরু বেষ্টন করে এটি প্রবাহিত হয়।
৫) জেট প্রবাহের উলম্ব বায়ু অংশীদারিত্ব ৫-১০ মিটার/সেকেন্ড (১৮-৩৬ কি.মি/ঘন্টা) অর্থাৎ জেট প্রবাহের উপরে অথবা নিচে বায়ুর গতিবেগ সেকেন্ডে ৫-১০ মিটার পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
৬) জেট প্রবাহের আনুভূমিক বায়ু অংশীদারিত্ব ৫ মিটার/সেকেন্ড (১৮কি.মি/ঘন্টা)। এই প্রবাহের নিম্নতম গতিবেগ ঘন্টায় ১০৮ কিলোমিটার বা সেকেন্ডে ৩০ মিটার।
৭) জেট প্রবাহের গতিবেগ গ্রীষ্মকাল অপেক্ষা শীতকালে দ্বিগুণ বেশি থাকে। সর্বোচ্চ গতিবেগ শীতকালে ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে দেখা যায়। সাধারণভাবে গতিসীমা ১৬০-৩২০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ৯০০০-১৫০০০ মিটার উচ্চতায় গতিবেগ সর্বাধিক হয়।
৮) গ্রীষ্মকালে উত্তরাভিমূখী অভিসরনের ফলে জেট প্রবাহের পরিধি সংকুচিত হয়ে পড়ে।তবে শীতকালে এটা উভয় গোলার্ধে ২০°অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
৯) উর্দ্ধাকাশে জেট প্রবাহের বাঁক ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে এক পর্যায়ে উচ্চ অক্ষাংশে উষ্ণ তাপকোষ ও নিম্ন অক্ষাংশে শীতল তাপকোষ সৃষ্টি করে।
১০) উভয় গোলার্ধে উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে মেরুবৃত্তীয় নিম্নচাপ বলয়ের মধ্যে জেট প্রবাহের অবস্থান হলেও ঋতু পরিবর্তনের কারণে চাপ বলয়ের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে জেট প্রবাহের অবস্থান পরিবর্তন ঘটে।
১১) জেট প্রবাহ চারটি পর্যায়ে বিকশিত হয়ে থাকে। প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যায় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ও বাঁক বৃদ্ধি পেতে পেতে এক পর্যায়ে মূল প্রবাহ অবলুপ্ত হয়ে নতুন প্রবাহের সৃষ্টি হয়। অতঃপর পুনরায় প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসে। চারটি পর্যায় সমাধা করতে ৪-৬ সপ্তাহ সময় লাগে।
১২)জেট বায়ু প্রবাহগুলি পৃথিবীকে বলয়াকারে বেষ্ঠন করে আছে। অর্থাৎ প্রবাহ অক্ষরেখার সাথে সমান্তরাল তবে ক্ষেত্রবিশেষে বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায়।
১৩) জেট প্রবাহ সমচাপ রেখাগুলির সাথে আঁকাবাঁকা পথে চলাতে ঢেউয়ের মত অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। আবহাওয়াবিদ কার্ল বুষ্টার রসবি সর্বপ্রথম বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন বিধায় এটি রসবি তরঙ্গ হিসাবে আখ্যায়িত।
১৪) উচ্চ অক্ষাংশে জেট প্রবাহের অন্তর্নিহিত অংশের গতিবেগ ডানপাশে বামপাশ অপেক্ষা বেশি থাকে। কিন্তু নিম্ন অক্ষাংশে এর বিপরীত অবস্থান পর্যবেক্ষিত হয়।
১৫) কখনো কখনো ট্রোপোস্ফিয়ারের মধ্যে জেট প্রবাহে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়ে বায়ুপ্রবাহ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩ কি.মি. এর মধ্যে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে শুষ্ক বায়ুর অনুপ্রবেশ জনিত কারণে আকাশ মেঘমুক্ত থাকে।
১৬)জেট বায়ুপ্রবাহের গতিসীমার আঞ্চলিক তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।ভারত মহাসাগরের উত্তর ভাগে এশিয়ার পূর্ব উপকূল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ও আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলে জেটবায়ু সর্বোচ্চ গতিতে প্রবাহিত হয়।
১৭)জেট বায়ুপ্রবাহ বিভিন্ন অক্ষাংশে উষ্ণতা ও শৈত্যের আদান-প্রদান করে থাকে।
১৮)জেট বায়ুপ্রবাহ পরোক্ষভাবে কোন কোন এলাকায় জলবায়ুর উপর প্রভাব বিস্তার করে।তবে মধ্য অক্ষাংশে ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টিপাত জেট প্রবাহের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
১৯) বিভিন্ন দ্রাঘিমাংশে জেট প্রবাহের গতিবেগে তারতম্য দেখা যায়। জেট প্রবাহের গতিবেগে দ্রাঘিমাংশের প্রভেদ টি সুপর্যবেক্ষিত।
জেট বায়ুপ্রবাহের শ্রেণীবিভাগ
অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে জেট বায়ুপ্রবাহ কে ৭ ভাগে বিভক্ত করা যায়।
১) মেরু প্রাচীর জেট প্রবাহ
২) উপক্রান্তীয় জেট প্রবাহ
৩) ক্রান্তীয় জেট প্রবাহ
৪) উপমেরু জেট প্রবাহ
৫) স্থানীয় জেট প্রবাহ
৬) তড়িৎ জেট প্রবাহ
৭) ব্যারিয়ার বা বাধাপ্রাপ্ত জেট প্রবাহ
১)মেরু প্রাচীর জেট প্রবাহ
শীতল মেরু বায়ুপুঞ্জ এবং উষ্ণ ক্রান্তীয় বায়ুপুঞ্জের সংযোগস্থল ৪০°-৬০°অক্ষাংশের মধ্যে এই জেট প্রবাহের উৎপত্তি ঘটে।দুটি ভিন্নধর্মী বায়ুপুঞ্জের সংযোগের কারণে তাপীয় নতিমাত্রা থাকে খাড়া।এর গতিপথ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এবং প্রায় সারাবছরই প্রবাহ বজায় থাকে। শীতকালে এই বায়ু সর্বাধিক গতিপ্রাপ্ত ও বিস্তৃত হয়।এ সময় দুই থেকে তিনটি ভিন্নতর প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বায়ুর গতিবেগ এই সময় ১০০ নটেরও অধিক থাকে।
উত্তর গোলার্ধে এটি পশ্চিমা প্রবাহ হিসাবে উত্তর-দক্ষিণের তরঙ্গায়িত ভাবে প্রবাহিত হয়। মাঝে মধ্যে এটি বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে বাঁক ও গতিবেগ বৃদ্ধি জনিত কারণে।এর অবস্থান মেরুবায়ু প্রাচীরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত হওয়াতে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। গ্রীষ্মকালে মেরু প্রাচীর জেট প্রবাহ উচ্চ অক্ষাংশে প্রাধান্য বিস্তার করে এবং এর গতিবেগ ও বিস্তার দুই-ই কমে আসে। উত্তর গোলার্ধ ব্যাতীত দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে একই ধরনের জেট প্রবাহ দেখা যায়।
২)উপক্রান্তীয় জেট প্রবাহ
উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয়ের উপর সৃষ্ট জেট প্রবাহটির অবস্থান ৩০°-৩৫°উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশে। পশ্চিমা প্রবাহ হিসাবে এটি সারাবছরই প্রবাহিত হয়। সাধারণ ভাবে এর গতিবেগ ১০০ নটিক্যাল মাইল বা কিছু বেশি হলেও সর্বোচ্চ গতিবেগ ৩০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারে। জাপান এবং দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের উপর ৩০০ নটিক্যাল মাইলেরও অধিক গতিসম্পন্ন জেট প্রবাহ পর্যবেক্ষিত হয়েছে।
৩)ক্রান্তীয় জেট প্রবাহ
গ্রীষ্মকালে ঊর্ধ্ব ট্রোপোস্ফিয়ারে ভারতীয় উপমহাদেশের উপর থেকে আফ্রিকার দিকে অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিমে একটি জেট প্রবাহ সৃষ্টি হয়।আর এই পূর্বালী জেট প্রবাহ বিশ্বের অন্যত্র পরিলক্ষিত হয়নি। মূলত: গ্রীষ্মকালীন অতিরিক্ত তাপদাহের কারণে এই প্রবাহটি সৃষ্টি হয়। এর গতিবেগ গড়ে ৭০ নটিক্যাল মাইল হলেও কোর এলাকায় ১০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারে।
৪)উপমেরু জেট প্রবাহ
ষ্ট্রাটোস্ফিয়ারের শীতকালীন অতি তীব্র গতিসম্পন্ন জেট প্রবাহের নাম উপমেরু জেট প্রবাহ বা পোলার নাইট জেট প্রবাহ। মেরু এলাকায় তাপের খাড়া নতিমাত্রার কারণে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩০-৮০ কিলোমিটার উচ্চতায় উপমেরু জেট প্রবাহ জন্মলাভ করে। শীতকালে বায়ুটি পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয় এবং গতিবেগ ঘন্টায় ৩৩০ নটিক্যাল মাইলের (৬৫০ কি.ম. এর অধিক) অধিক রেকর্ডকৃত হয়েছে আকর্টিক এলাকায়।
৫)স্থানীয় জেট প্রবাহ
স্থানীয়ভাবে তাপমাত্রা ও তাপ-চাপের পার্থক্য হেতু অনেক সময় ঊর্ধ্ব বায়ুমন্ডলে তরঙ্গায়িত বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয় আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে।
৬)তড়িৎ জেট প্রবাহ
মেসোস্ফিয়ার ও থার্মোস্ফিয়ারের মধ্যে তাপীয় ও তাপ গতীয় ব্যতিক্রমের কারণে তরঙ্গায়িত জেট প্রবাহের সৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে এই জেট প্রবাহের দিক ও গতিবেগ এখনো সুপর্যবেক্ষিত নয়।
৭)ব্যারিয়ার বা বাধাপ্রাপ্ত জেট প্রবাহ
এই ধরনের জেট প্রবাহ পার্বত্য অঞ্চলের উপরিভাগে সৃষ্টি হয়ে থাকে। পর্বতের বাধা নিম্ন বায়ুমন্ডলের বায়ু প্রবাহের গতি ৪৫% বাড়িয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট প্লেন (মধ্যভাগের বিশাল সমভূমি) এলাকায় দক্ষিণা ভিমূখী নিম্ন স্তরের জেট প্রবাহ গ্রীষ্মকালে রাত্রিব্যাপী বজ্র ঝড় ত্বরান্বিত করে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে একই ধরনের জেট প্রবাহ কোরাল সাগর থেকে মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আর্দ্রতা আনয়ন করে।
জেট প্রবাহের জীবন চক্র
জেট প্রবাহ চারটি পর্যায়ে বিকশিত হয়ে থাকে। প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যায় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ও বাঁক বৃদ্ধি পেতে পেতে এক পর্যায়ে মূল প্রবাহ অবলুপ্ত হয়ে নতুন প্রবাহের সৃষ্টি করে। অতঃপর পুনরায় প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসে। চারটি পর্যায় সম্পন্ন করতে ৪-৬ সপ্তাহ সময় লাগে। অর্থাৎ একটি জেট প্রবাহ চারটি পর্যায়ে তার জীবন চক্র সম্পন্ন করে।
প্রথম পর্যায়
প্রথম পর্যায়ে জেট প্রবাহ মেরু অঞ্চলে অবস্থান করে। এ পর্যায়ে উত্তরে শীতল মেরু বায়ুপুঞ্জ এবং দক্ষিণে উষ্ণ পশ্চিমা বায়ুর দ্বারা পৃথক থাকে। এ পর্যায়ে জেট প্রবাহ পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রায় সোজা পথে প্রবাহিত হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়
এ পর্যায়ে জেট প্রবাহে বাঁক বা তরঙ্গ সৃষ্টি হয় এবং বায়ু স্রোত নিরক্ষরেখার দিকে বিস্তার লাভ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে উচ্চ ও নিম্ন অক্ষাংশের মধ্যে বায়ুর আদান-প্রদান শুরু হয় এবং বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ কিছুটা হ্রাস পায়।
তৃতীয় পর্যায়
তৃতীয় পর্যায়ে জেট প্রবাহের তরঙ্গগুলি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। বিশাল তরঙ্গের প্রভাবে শীতল মেরু বায়ু প্রবাহ নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে এবং উষ্ণ বায়ুপুঞ্জ মেরু অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়। তৃতীয় পর্যায়ে জেট প্রবাহ আবহাওয়ার উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
চতুর্থ পর্যায়
চতুর্থ বা শেষ পর্যায়ে জেট প্রবাহের তরঙ্গগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক বায়ুকোষ গঠন করে উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ আকারে এ পর্যায়ে অনেকগুলি বায়ুকোষ সৃষ্টি হয়।এ প্রেক্ষিতে উষ্ণ বায়ু উত্তরের দিকে এবং শীতল বায়ু দক্ষিণে অগ্রসর হয়।
জেট প্রবাহের প্রভাব/তাৎপর্য/জলবায়ুতে প্রভাব
স্থানীয় ও আঞ্চলিক জলবায়ুর উপর জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহের প্রভাব রয়েছে। বিশেষত: আবহাওয়ার বিশেষ বিশেষ কিছু ঘটনা সরাসরি জেট প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।আবহাওয়া জলবায়ুর সাথে জেট প্রবাহের সম্পৃক্ততা নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা যায়:
১) মধ্য অক্ষাংশ বা নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের ঘূর্ণিঝড়ের সাথে জেট প্রবাহের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।জেট প্রবাহ মধ্য অক্ষাংশের ঘূর্ণিঝড়কে শক্তিশালী করে। ভূপৃষ্ঠের উপরে ট্রোপোস্ফিয়ারে জেট প্রবাহের অবস্থানের ফলে ঘূর্ণিঝড় প্রবল থেকে প্রবলতর এবং বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক এর চাইতে বেশি হয়।
২) ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে জেট প্রবাহের অবস্থানের জন্য ভূপৃষ্ঠের উপরস্থ ঘূর্ণিবাত্যা কিংবা প্রতীপ ঘূর্ণিবাত্যা তাদের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে-ফলে স্থানীয় আবহাওয়ার স্বাভাবিকত্ব বজায় থাকে না।
৩)জেট প্রাবাহ ঊর্ধ্ব ট্রোপোস্ফিয়ারে অনুভূমিক অভিসরন ও প্রতিসরনের সৃষ্টি করে। ঊর্ধ্ব বায়ুতে অভিসরণ জনিত কারণে প্রতীপ ঘূর্ণিবাত্যা এবং প্রতিসরনের কারণে ঘূর্ণিবাত্যা সৃষ্টি হয়।
৪) জেট প্রবাহের ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী উলম্ব প্রবাহ দ্রুত ট্রোপোস্ফিয়ার ও স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্যে বায়ুর মিশ্রণ ঘটায়। মানব সৃষ্ট দুষকসমূহও এই প্রক্রিয়ায় ঊর্ধ্ব বায়ু মন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে।উদাহরণস্বরূপ হিসেবে বলা যায় যে ওজন স্তর ক্ষয়কারী ক্লোরো ফ্লোরোকার্বন জেট প্রবাহের মাধ্যমেই নিম্ন ট্রোপোস্ফিয়ার থেকে উর্ধ্বকাশে নীত হয়।
৫) এছাড়াও দেখা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার মৌসুমী জলবায়ু উর্ধ্ব ট্রোপোস্ফিয়ারের জেট প্রবাহ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়।
৬)জেট প্রবাহ বায়ুর উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ সৃষ্টিতে বিশেষ ভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। উত্তর গোলার্ধে বায়ুর গতিবেগ ও চাপ বেশি হলে জেট প্রবাহ ডান দিকে চলে আসে এবং সেখানে একটি উচ্চচাপের সৃষ্টি করে যা' Anti Cyclone Genesis' নামে আখ্যায়িত।উচ্চ বায়ু স্তরে উচ্চচাপ থাকলে নিম্ন স্তরে কেন্দ্রমুখী বায়ু প্রবাহিত হয়ে ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টিপাত সৃষ্টি হয়।
৭) অক্ষাংশগত তাপসমতা রক্ষায় জেট বায়ু প্রবাহ মেরু অঞ্চলের শীতলবায়ু উষ্ণমন্ডলে এবং উষ্ণ মন্ডলের বায়ু মেরু অঞ্চলের দিকে নিয়ে যায়। ২০°-২৬°অক্ষাংশের মধ্যে তরঙ্গায়িত জেট প্রবাহের নিয়মিত অবস্থানের ফলে অক্ষাংশিক তাপসমতা রক্ষায় বিশেষ সহায়ক হয়।
ব্যবহার:
মেরু প্রাচীর জেট প্রবাহ উত্তর গোলার্ধে বিমান চালনা ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উত্তর গোলার্ধে উত্তর আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপে এর বিস্তৃতি থাকাতে এবং উপক্রান্তীয় জেট প্রবাহ থেকে এর উচ্চতা কম থাকায় এই বায়ুপ্রবাহের গুরুত্ব বেশি। দক্ষিণ গোলার্ধে এই জেট প্রবাহ মূলত এন্টার্কটিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত থাকাতে ব্যবহারিক গুরুত্ব কম।
ভবিষ্যৎ শক্তি উৎপাদন:
বিজ্ঞানীরা জেট প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন।ঐ প্রযুক্তি আগামী ১০-২০ বছরের মধ্যে কার্যকর করা সম্ভব হবে। তবে বিশ্বের বর্তমান চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ এর থেকে পূরণ করা সম্ভব হবে।
সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে জাপান জেট স্ট্রীমের প্রবাহ পথে অগ্নি বেলুন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভাগে কিছু ক্ষতিসাধন করে। এতে উপকূলীয় এলাকায় ছয় ব্যক্তির প্রাণহানিসহ বসতি ও সম্পদ নষ্ট হয়।
বিমানচালনায় গুরুত্ব:
জেট স্ট্রীমের অবস্থান বিমান চালনার ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্ববাহী।১৯৫২ সালের ১৮ নভেম্বর সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় এই বায়ু প্রবাহের।প্যান অ্যামের একটি বিমান জেট প্রবাহের গতিপথ ব্যবহার করে এক তৃতীয়াংশ কম সময়ে টোকিও থেকে হনলুলু পৌঁছায়। শুধু সময় নয় বিমানের জ্বালানি সাশ্রয়ের ক্ষেত্রেও জেট প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমেরিকার মধ্যে জেট প্রবাহের গতিপথে বিমান চালনা করে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যেতে ৩০ মিনিট বা তার বেশি কম সময় লাগে।
শেষ কথা
জেট স্ট্রীম বা জেট প্রবাহ পশ্চিম থেকে পূর্বে নিয়ত প্রবাহমান।যুদ্ধবিমান চালনার সময় বৈমানিকেরা এই বায়ুপ্রবাহের অস্তিত্ব অনুভব করেন বলে একে জেট প্রবাহ নামে নামকরণ করা হয়েছে। সুতরাং আজকের আর্টিকেলে জেট স্ট্রিম বা জেট প্রবাহ কী?-জেট প্রবাহের বৈশিষ্ট্য,শ্রেণীবিভাগ ও জলবায়ুর উপর প্রভাব বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।