বাংলাদেশের কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন বাংলাদেশের কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা আজকের আর্টিকেলে কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব।তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
এদেশের কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং বাংলাদেশের কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব আলোচনা করা হলো:
ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল।কৃষির উৎপাদনশীলতা ও ঘাটতি প্রাক্কলনের উপরই নির্ভর করে এদেশের বাৎসরিক এবং প্রেক্ষিত উন্নয়ন পরিকল্পনা। কিন্তু কৃষির উন্নতির জন্য এখনও সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা সময়োপযোগী করা সম্ভব হয়নি।তাই বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা আজও মৌসুমী জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব
কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ কৃষি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় আশানুরূপ সাফল্য লাভ করতে পারেনি। কারণ এদেশের কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব/গুরুত্ব আলোচনা করা হলো।
১) মৃত্তিকায় পানি সরবরাহ
পরিমিত পানি উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টি ও ফলবতী হওয়ার পূর্বশর্ত।২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে সেচের অধীন কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৫৪. ১০ লক্ষ হেক্টর।এছাড়াও বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ু তথা বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর শীল।বাংলাদেশের প্রধান ফসল যেমন- ধান, পাট, ইক্ষু, ভুট্টা,চা প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য কৃষি জমিতে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়।
তাছাড়া মাটির পানি ধারণ ক্ষমতার উপর মাটির উর্বরতা তথা কৃষি উৎপাদন নির্ভর করে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত বর্ষাকালে হয় বলে অধিক পরিমাণ জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন সম্ভব হয়। তাছাড়া জলবায়ু উষ্ণ, আর্দ্র ও সমভাবাপন্ন বলে ধান, পাট, ইক্ষু, চা প্রভৃতি ভালো জন্ম।
২) চাষাবাদ
মৃত্তিকার আদ্রর্তা বীজের অঙ্কুরোদগমের পূর্বশর্ত। তবে বাংলাদেশের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র হাওয়ায় জমিতে চাষ দেওয়ার সময় মৃত্তিকার আর্দ্রতা বজায় থাকে। তাছাড়া গ্রীষ্মকালে অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের জন্য মৃত্তিকার আদ্রর্তা বেড়ে যায়।মৃত্তিকার আদ্রর্তা বজায় থাকলে ধান, পাট, ইক্ষু,চা ইত্যাদি ফসল বেশি জন্মে।
৩) পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন
বাংলাদেশে মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে কৃষি পণ্য উৎপাদনে পাহাড়ি অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।এছাড়াও মৌসুমী জলবায়ুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি অঞ্চলকেও আমরা আমাদের অনুকূলে ব্যবহার করতে পারি। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ কারণে এখানে বৃষ্টিপাত সহনশীল ফসল চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।ফলে এ অঞ্চলের চা ও রাবার ভালো জন্মে। তাছাড়া পার্বত্য বনভূমির বিভিন্ন বৃক্ষ মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
৪) ফসল উৎপাদন
মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে অধিক বৃষ্টিপাত হয় বলে ধান,পাট,চা, ইক্ষু ইত্যাদি ফসল ভালো জন্মে। এতে দেশের মানুষের খাদ্যশস্যের চাহিদা পূরণ হয়। অপরদিকে শীতকাল বৃষ্টিহীন থাকায় ডাল, গম, তেল বীজ, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি ফসল ভালো জন্মে।
৫) উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধি
বাংলাদেশের কৃষির উপর মৌসুমী বৃষ্টিপাতের প্রভাব অত্যন্ত বেশি।যে বছর নিয়মিত ও পরিমিত বৃষ্টি হয়, সে বছর ভালো ফসল উৎপাদন হয় অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।আবার যে বছর বৃষ্টিপাত কম-বেশি বা অনিয়মিত হয়, সে বছর উৎপাদন ভালো হয় না অর্থাৎ উৎপাদন হ্রাস পায়।
তাছাড়া সুষ্ঠু সেচ ব্যবস্থার অভাবে অধিকাংশ জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়।কম বৃষ্টিপাতের ফলে খরা দেখা দেয়। অধিক বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা ও বন্যা দেখা দেয়। ফলে কৃষকরা তাদের ফসল আর বাড়িতে আনতে পারে না। তাছাড়া কালবৈশাখী ঝড়ের ফলে বহু ফসল বিনষ্ট হয়।
৬) কৃষি নির্ভর শিল্পের বিকাশ
বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা কৃষি পণ্যের উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু অনুকূলে থাকায় এদেশের পাট, চা,চিনি,বস্ত্র প্রভৃতি কৃষি নির্ভর শিল্প গড়ে উঠেছে। তাছাড়া কাঁচামাল, শ্রমিক, পরিবহন প্রভৃতির উপর জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে যা কৃষি নির্ভর শিল্পের বিকাশে সহায়ক।
৭) বনজ সম্পদ
বনজ সম্পদ বৃদ্ধিতে মৌসুমী জলবায়ুর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।বাংলাদেশে মৌসুমী বৃষ্টিপাত প্রচুর পরিমাণে হয় বলে বনজ সম্পদের পরিমাণও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বনজ সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারনে বাংলাদেশের বনাঞ্চলে বিভিন্ন মূল্যবান গাছ যেমন শাল,সেগুন, সুন্দরী, গেওয়া, কড়ই, চাপালিশ, শিশু, গর্জন ইত্যাদি জন্মে। তাছাড়া বাঁশ, মুলি,গোলপাতা,বেত,মধু, মোম ইত্যাদিও এদেশের গুরুত্বপূর্ণ বনজ সম্পদ।
৮) মৎস্য চাষ
কৃষির যেসব উপখাত রয়েছে তার মধ্যে মৎস্য অন্যতম। বর্ষাকালে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ সময়ে নদী-নালা, খাল-বিল পানিতে ভরে যায়। সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ ও গলদা চিংড়ি প্রজননের জন্য নদীর মোহনা ও ভরা নদীতে উঠে আসে। তাই বর্ষাকালে এদেশে প্রচুর পরিমাণে মাছ ধৃত হয়।সুতরাং বলা যায়, কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত হিসেবে মৎস্য চাষের উন্নয়নে মৌসুমী জলবায়ুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৯) পশু সম্পদ
কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো পশু সম্পদ।মৌসুমী জলবায়ু কৃষির অনুকূলে হলে পশু খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।অর্থাৎ সময়মতো বৃষ্টিপাত হলে প্রচুর পরিমাণে পশু খাদ্য উৎপাদিত হয়। ফলে দেশের গবাদি পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়।
১০) পরিবহন ব্যবস্থা
কৃষি পণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনের ক্ষেত্রে জলপথ অনন্য ভূমিকা পালন করে। তবে বিশেষ করে বর্ষাকালে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে এদেশের নদ-নদী গুলো প্রায় সারা বছর নাব্য থাকে। ফলে জল পথে পণ্য পরিবহন সহজতর হয়। তাছাড়া জলপথে কৃষি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে খরচও কম হয়।
১১) অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য
মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে কৃষি ব্যবস্থা অনুকূল অবস্থা বিরাজ করলে ফসলের সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও প্রসার ঘটে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয় এবং জনগণের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পায়।
১২) কুটির শিল্পের উপকরণ সরবরাহ
বাংলাদেশের কুটির শিল্প গুলো উপকরণ হিসেবে কৃষি পণ্য ব্যবহার করে থাকে।বাঁশ, কাঠ, বেত, ইত্যাদি কৃষি পণ্য কুটির শিল্পে প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এসব কৃষি পণ্যের স্বাভাবিক বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে কুটির শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ পাওয়া সহজ হয়।
১৩) বৈদেশিক বাণিজ্য
মৌসুমী জলবায়ু বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য কৃষির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের ফলে দেশে রপ্তানিযোগ্য কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।এসব উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয়। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অবস্থান মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে হওয়ায় এদেশে সারা বছরই অল্প বিস্তর বৃষ্টিপাত হয়। তবে এ দেশের পূর্বাঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বনভূমি ও পাহাড়-পর্বতের আধিক্য থাকায় পশ্চিম দিক অপেক্ষা পূর্ব দিকে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এদেশের কৃষিতে মৌসুমী জলবায়ু বা বৃষ্টিপাতের প্রভাব খুব বেশি এবং প্রধান প্রধান কৃষিপণ্য হিসেবে ধান, পাট, চা, ইক্ষু বেশি জন্মে।আজকের আর্টিকেলে কৃষির উপর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব আলোচনা করা হয়েছে।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।