ভূগোলের সংজ্ঞা দাও-ভূগোলের মূল শাখাসমূহ আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে ভূগোলের সংজ্ঞা দাও-ভূগোলের মূল শাখাসমূহ আলোচনা করার চেষ্টা করব।প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভূগোলের নানাবিধ সংজ্ঞা রয়েছে।আর এই সংজ্ঞা গুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
ভূগোলের সংজ্ঞা দাও-ভূগোলের মূল শাখাসমূহ আলোচনা কর
আজকের আর্টিকেলে বর্ণিত হয়েছে ভূগোলের সংজ্ঞা দাও-ভূগোলের মূল শাখাসমূহ আলোচনা কর।মূলত ভূগোল শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আজকের আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়লে ভূগোলের সংজ্ঞা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন।

ভূমিকা

বাংলা ভাষায় ভূগোল শব্দের অভিধানগত অর্থ হলো 'পৃথিবী গোলাকার'।'ভূ' দ্বারা পৃথিবী এবং 'গোল'দ্বারা গোলাকারকে বোঝানো হয়েছে।আর পূর্বে ভূগোল বলতে সাধারণত দেশের নাম, এর রাজধানী, শহর প্রভৃতি সম্বন্ধে বুঝাত।বর্তমানে এই বিষয়ের পরিধি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।এখন দেশের পরিবেশগত অবস্থার সাথে মানুষের সম্বন্ধে ভূগোল বিষয়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এখানে পরিবেশ বলতে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক উভয় অর্থের ব্যবহার হয়েছে। মানুষকে কেন্দ্র করে ভূগোল বিষয়টি লিখিত হয়েছে কারণ, মানুষের উন্নতি সকলের কাম্য।


পরিবেশগত অবস্থা ও সম্পদকে কিভাবে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করা যায় এটিই ভূগোলবিদগণের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তাই যে বিষয় স্থানিক ও কালীক (Spatial and temporal) পর্যায় মানুষের সাথে পরিবেশের বহুমুখী সম্পর্ক চর্চা বা ব্যাখ্যা করে তাকেই ভূগোল বলে। এ কারণে সকলেরই এ বিষয়টি অধ্যয়ন করা উচিত।কারণ দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ ও তার পার্থিব ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের বর্ণনায় 'ভূগোল' বিষয়ের মূল বিষয়বস্তু।

ভূগোলের ধারণা (Concept of Geography)

পৃথিবীতে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে যাত্রা যেদিন থেকে, সেদিন থেকে মানুষ তার পরিসর,পারিপার্শ্বিকতা ও পরিবেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে আসছে।ভৌগোলিক জ্ঞানের ধারণা শুরু ও সম্ভবত সেদিন থেকেই।এই ধরনের অনুমানের যথার্থতাও রয়েছে।কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সমূহের মধ্যে ভূগোল শাস্ত্র সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।

ভারতীয় পন্ডিত "সূর্য সিদ্ধার্থ" ভূগোল শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন।প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু,বৌদ্ধ,জৈন, প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ এবং প্রাচীন পুরানা সমূহে ভূগোল ও খগোল Cosmography এর প্রতিশব্দ শব্দটি প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হতো এবং অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মতো প্রাচীন ভারতেও ভূগোল শাস্ত্রের পরিধি‌ ছিল ব্যাপক ও ধর্মাশ্রয়ী।


সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ভূগোল শব্দের অর্থ হলো, পৃথিবী গোলাকার, এর ইংরেজি অর্থ Geography.(Geo)= অর্থ পৃথিবী,(graphy)= অর্থ বর্ণনা।যাইহোক বাংলায় এর যে পরিচয় বা যে নামই দেওয়া হোক না কেন ভূগোল ইংরেজি প্রতিশব্দ "Geography"হিসাবে নামটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে।

গ্রিক পন্ডিত ইরাটোসথেনিস(জে.২৭৬ খ্রিস্টপূর্ব) সর্বপ্রথম মানুষের আবাসস্থল হিসেবে পৃথিবীর সম্পর্কে বর্ণনা করতে Geography শব্দটি ব্যবহার করেন।Geo এবং Graphia নামক দুটি গ্রিক শব্দ দ্বারা Geography কে নামকরণ করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে" Geo"অর্থ কঠিন,তরল ও বায়বীয় পদার্থ নিয়ে গঠিত পৃথিবী এবং 'Graphia' বলতে উক্ত পৃথিবীর বর্ণনা।সুতরাং তার ধারণা অনুযায়ী 'Geography' হচ্ছে মানুষের আবাসস্থল এই পৃথিবীর বর্ণনা।


এছাড়া 'Geography' শব্দটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে V.C. Kinegsland এবং W.B. Cornish বলেন The word geography is of greack origin.It is derived from two words meaning the 'Earth' and write about'Hence its literal meaning is a written description of the earth'

Geography শব্দটি গ্রীক থেকে উৎপত্তি। এর দুইটি অর্থ পৃথিবী এবং এর সম্পর্কে লেখা।সুতরাং এর ভাষা গত অর্থ হচ্ছে যে পৃথিবী সম্পর্কে লিখিত বর্ণনা।অতএব বলা যায়, প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের যে গভীর এবং সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে তার অনুশীলনই ভূগোলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।


সুপ্রাচীন কাল থেকে ভৌগোলিক জ্ঞানের চর্চা এবং বিকাশের ফলে নানাভাবে ভূগোল শাস্ত্রের বিবর্তন হয়েছে কখনো দেখা যায়, বৈচিত্র্যের বিজ্ঞান হিসেবে, ভূ-বিজ্ঞান হিসাবে, পরিবেশ বিজ্ঞান হিসাবে, সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে, আঞ্চলিক বিজ্ঞান হিসেবে আবার কখনো বা পারিসরিক বিজ্ঞান হিসেবে। তবে যে পরিচয় দেয়া হোক না কেন "ভূগোল' বা (Geography) নামটি আজও সমান জনপ্রিয় এবং ভূগোল মূল সুর হিসাবে পৃথিবী ও মানুষের কাছে তা আজও অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে।

ভূগোলের সংজ্ঞা

প্রাচীন গ্রিক যুগের আদিকাল থেকেই ভূগোল শব্দটি ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাথমিকভাবে অবশ্য পৃথিবী ও তার বিভিন্ন অংশের সকল প্রকার বিবরণই ছিল ভূগোলের বিষয়বস্তু।ক্রমান্বয়ে মূল শিকড় থেকে ক্লাসিক্যাল এবং রেনেসাঁর ভ্রমণ যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পরিবেশ বিজ্ঞান হিসেবে ভূগোলের বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে ভূগোলের যে গ্রহণ ক্ষমতা বেড়েছে, তা পাঠ্য বিষয়বস্তু এবং অধ্যয়ন পদ্ধতির আমুল পরিবর্তন,প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুসন্ধানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অভিযোজন এবং সাম্প্রতিককালে পরিসংখ্যান ও আচরণ বা কৌশলের অন্তর্ভুক্তি তাই প্রমাণ করে।


ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভূগোল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিষয় হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।এর ধারাবাহিকতায় ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ,১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ভূগোল মানব পরিবেশ সম্পর্ক'কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।এছাড়াও ভূগোলবিদরা মানব পারিসরিক বিন্যাস সম্বন্ধে এবং আমাদের পরিবেশের সাথে বাস্তব সম্পর্ক নির্ধারণের উপর আলোকপাত করেন।প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে ভূগোলের সংজ্ঞার মধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ভূগোল শাস্ত্রের সংজ্ঞা প্রদানের ইতিহাসকে মোট তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়।পর্যায়গুলো হলো:

১) প্রাচীন যুগের সংজ্ঞা

২) মধ্যযুগের সংজ্ঞা

৩) আধুনিক বা সাম্প্রতিককালের সংজ্ঞা

১)প্রাচীন যুগের সংজ্ঞা

প্রাচীন যুগে ভূগোলের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ভূপৃষ্ঠের বৈচিত্র্যময় বর্ণনা।প্রাচীন যুগে ভূগোলের সাধারণ সংজ্ঞা ছিল পৃথিবীর সম্পর্কে বর্ণনা।

১)ইরাটোসথেনিস

প্রাচীন সভ্যতার গ্রিক পন্ডিত ইরাটোসথেনিস জিওগ্রাফি (Geography) শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। তিনি ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,"পৃথিবীর বর্ণনায় হলো ভূগোল"।

২)স্ট্রাবো

প্রাচীন রোমান সভ্যতার পণ্ডিত স্ট্রাবো ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,"ভূগোল আমাদের পৃথিবীর পানিরাশি ও স্থলভাগের মধ্যে সমস্ত জীব সম্পর্কে জ্ঞান দেয় এবং একইভাবে ব্যাখ্যা করে পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে"।

৩)ক্লোডিয়াস টলেমি

প্রাচীন রোমান পন্ডিত ক্লোডিয়াস টলেমি ভূগোলকে একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্র হিসাবে রূপায়ণ করেন, তিনি উল্লেখ করেন, "ভূগোল সেই মহান বিজ্ঞান যা মহাবিশ্বের মধ্যে পৃথিবীকে এক ঝলক দেখায়"।অর্থাৎ টলেমির ভূগোলের সংজ্ঞা ছিল এই রূপ, যে শাস্ত্র পাঠ করলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের অবস্থান ও সমুদ্র পথের বিবরণ সম্পর্কে বিশদভাবে অবগত হওয়া যায় তাকেই ভূগোল বলে"।

২)মধ্যযুগের সংজ্ঞা

খ্রিস্টীয় ৩০০ সাল থেকে ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ বলে। এই যুগে ভূগোলের প্রধান সংজ্ঞা হলো পৃথিবীর জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মাটি, উদ্ভিজ্জ, কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা, জনসংখ্যা ও মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী বর্ণনা করা।

১)ইমানুয়েল কান্ট

জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ভূগোলের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন,"ভূগোল হলো পৃথিবীর পঠন পাঠন, এটি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে তারতম্য দেখা যায় তা বিশ্লেষণ করে, ভূগোল ঘটনা ও জীবন্ত সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে।

২)ভ্যারিনিয়াস

ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগের দিকে ভ্যারিনিয়াস প্রথম ভূগোলকে প্রাকৃতিক ও মানবিক এই দুই ভাগে বিভক্ত করেন।ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ভূগোল হচ্ছে গণিতের মিশ্রিত অংশ যা পৃথিবীর অবস্থা এবং এর অংশ সমূহের পরিমাণগত, যেমন- এর আকার, স্থান, বিশালতা এবং গতি, সেই সাথে মহাকাশ সম্পর্কিত বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করে"।

৩)আধুনিক বা সাম্প্রতিককালের সংজ্ঞা

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ভৌগোলিক পান্ডিত্যে এক ঝাঁক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। প্রখ্যাত ভূগোলবিদ যেমন- আলেকজান্ডার হামবোল্ডট, কার্ল রিটার,পল ভিদাল ডি লে ব্লাচ, হ্যাকল, রাটজেল, স্যাম্পেল, হান্টিংটন, ফোবর প্রমুখ প্রথিতযশা ভূগোলবিদ ভূগোল শাস্ত্রকে একটি নতুন আঙ্গিকে সজ্জিত করেন। আর এই শতাব্দীতে নির্মিত ভূগোল শাস্ত্রকে আধুনিক ভূগোল (Modern Geography) বলে। আধুনিক ভূগোল নির্মাণকারী মনীষীদের আধুনিক ভূগোল নির্মাণকারী (Makers of Modern Geography) বলা হয়।

আলেকজান্ডার হামবোল্ডের মতবাদটি পরবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যক ভূগোলবিদ এই নতুন ধারণাকে অনুসরণ করে ভূগোলের নতুন নতুন সংজ্ঞা প্রদান করে। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা বর্ণিত হলো:

১)আলেকজান্ডার হামবোল্ড(Alexander Humbolt)

হামবোল্ড ভূগোলকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, "পৃথিবীতে যা কিছু দৃশ্যমান তার সবকিছুর বর্ণনা করাই হলো ভূগোলের অংশ।তিনি আরো বলেন যে"ভূগোল হল মাতৃশাস্ত্র যেখান থেকে সকল শাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছে।

২)কার্ল রিটার (Carl Ritter)

কার্ল রিটার ভূগোলকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অবলোকন করেন। তিনি বলেন, ভূগোল হল বিজ্ঞানের সেই বিভাগ যা গোলকের ভূমিরূপ,প্রণালী ও সম্পর্ককে স্বাধীন অংশ হিসাবে আলোচনা করে এবং এগুলোর সমষ্টির সাথে মানুষ ও মানুষের সৃষ্টিকর্তার যোগাযোগ প্রদর্শন করে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, "ভূগোল হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া বিষয়ক একটি পঠন-পাঠন।

৩)পল ভিদাল ডি লে ব্লাচ (Paul Vidal de le Balche)

ফরাসি পণ্ডিত পল ভিদাল ডি লে ব্লাচ ভূগোলের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে ব্যক্ত করেন যে, "ভূগোল হল স্থান সমূহের বিজ্ঞান, মানুষের নয়।

৪)ভূগোলবিদ হার্টশ্যোর্ন (Hartshorne 1939)

ভূগোলবিদ হার্টশ্যোর্ন এর মতে, ভূগোল হল ভূপৃষ্ঠের চলমান বৈশিষ্ট্যের সঠিক, সাজানো এবং যৌক্তিক বর্ণনা এবং বিশ্লেষণের সাথে সংশ্লিষ্ট।

৫)কার্ল ও সওয়ার (Karl O Saur)

প্রখ্যাত জার্মান ভূগোলবিদ কার্ল ও সওয়ার ভূগোলের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেন,"ভূগোল কোনদিনই মানুষ সম্পর্কিত বিজ্ঞান ছিল না। ভূগোল ছিল ভূপৃষ্ঠের ভূমি সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান যেখানে মানুষ বসবাস করে।

৬)মনখহাউজ (Monkhause,1953)

প্রখ্যাত ব্রিটিশ ভূগোলবিদ মনখহাউজ ভূগোলের সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে,"মানুষের আবাস ভূমি হিসেবে ভূপৃষ্ঠের পারিসরিক পার্থক্যের পঠন-পাঠন কে ভূগোল বলে।

৭)স্যার ডাডলি স্ট্যাম্প (Sir Dudlley Stamp,1966)

বিশিষ্ট ব্রিটিশ ভূগোলবিদ স্যার ডাডলি স্ট্যাম্প ভূগোলের তিনটি সংজ্ঞা প্রদান করেন। সংজ্ঞা তিনটি নিম্নরূপ-
  • ভূগোলে পৃথিবী ও তার অধিবাসীদের বর্ণনা করা হয়।
  • ভূগোল পৃথিবী তথা মানুষের পরিস্থিতি সমূহের বিজ্ঞান।
  • ভূগোল ভূপৃষ্ঠের বর্ণনা ও এলাকাসমূহের সম্পদ বিষয়ে আলোচনা করে।

৮)রাটজেল (Ratzel)

প্রখ্যাত জার্মান ভূগোলবিদ রাটজেল বলেন, ভূগোল হলো ভূপৃষ্ঠের এবং এর অধিবাসীদের একটি বিজ্ঞান।

৯)ইলেন স্যাম্পেল (Ellen Sample)

ভূগোল হলো প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানবজাতির আন্তঃক্রিয়ার একটি পঠন-পাঠন।তিনি আরো বলেন, "ভূগোল হলো মানুষের বাস্তুতন্ত্রের পঠন-পাঠন।

১০)পিটার হ্যাগেট (Peter Hagget)

ব্রিটিশ ভূগোলবিদ পিটার হ্যাগেট বিভিন্ন সময়ে ভূগোলে বিভিন্ন সংজ্ঞা দেন।তিনি বলেন,"ভূগোল হলো বিজ্ঞানের সকল শাখার মধ্যে একমাত্র এবং একক বিষয় যা শুধু মাত্র দেখায় বিশ্বাস করে।

১৯৮১ সালে পিটার হ্যাগেট ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বর্ণনা করেন যে,"ভূগোল হলো একটি পরিসর হিসাবে ভূপৃষ্ঠের পঠন-পাঠন যে পরিসরে মানুষ বসবাস করে।

১৯৭২ সালে পিটার হ্যাগেট ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "ভূগোল হলো সেই বিজ্ঞান যা ভূপৃষ্ঠের মানুষের পরিবেশের বস্তুতন্ত্র এবং অঞ্চলের পারিসরিক ও তাদের গঠন এবং পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ে সমীক্ষা করে।

১১)প্রখ্যাত মার্কিন ভূগোলবিদ গ্রিফিথ টেইলর (Griffith Taylor)

ভূগোলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, "ভূগোল হলো মানুষ এবং প্রাকৃতিক প্রণালীগুলোর মধ্যে সম্পর্কে পঠন-পাঠন যা অশ্বমন্ডল, বায়ুমণ্ডল এবং পানিমণ্ডলে সংঘটিত হয়।তিনি আরো উল্লেখ করেন,ভূগোল মানুষের জীবন কর্ম এবং চিন্তার উপরে অশ্বমন্ডল, বায়ুমণ্ডল ও পানিমণ্ডলের প্রভাব এবং হিসাব-নিকাশের একটি পঠন পাঠন।

ভূগোলের মূল শাখাসমূহ

ভূগোল শাস্ত্রের বিষয় সমূহ জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।এ কারণে ভূগোল শাস্ত্রকে নানা শাখা প্রশাখায় বিভক্ত করা হয়।যেহেতু ভূগোল শাস্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো প্রকৃতি ও মানুষ সেহেতু ভূগোল শাস্ত্রকে প্রধানত: দুইটি শাখায় বিভক্ত করা হয়। যথা-
১) প্রাকৃতিক ভূগোল (Physical Geography)
২) মানবিক ভূগোল (Human Geography)

১)প্রাকৃতিক ভূগোল(Physical Geography)

প্রকৃতিতে নানা শক্তি সতত সক্রিয়।এই শক্তিগুলো হলো সূর্য থেকে আগত সৌরশক্তি, তাপশক্তি ও বিদ্যুৎশক্তি এবং পৃথিবীর নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও চুম্বক শক্তি। এ সকল শক্তি স্বয়ংক্রিয় এবং পরস্পর পরস্পরের সাথে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত।এ সকল শক্তিসমূহ সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর উপরিভাগে ক্রিয়া করে নানা প্রকার ভৌগোলিক বিষয় (feature) এবং প্রাকৃতিক সিস্টেম(Natural systems) নির্মাণ ও গঠন করে।


প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা নির্মিত ভৌগোলিক সিস্টেম ও বিষয়গুলোর পঠন পাঠনকে প্রাকৃতিক ভূগোল বলে। প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা নির্মিত ও সম্পাদিত ভৌগোলিক বিষয় ও সিস্টেমগুলো হল মহাদেশীয় সঞ্চালন আগ্নেয়গিরির আগ্নেয় উদগীরন। ভূকম্পন, পর্বত ও দ্বীপপুঞ্জের সৃষ্টি ও বন্টন, হিমবাহ ও নদ-নদীর প্রবাহ,সমুদ্রস্রোত ও বায়ু প্রবাহ ইত্যাদি।প্রাকৃতিক ভূগোলের পঠন-পাঠন কেন্দ্রীভূত থাকে।


এছাড়া প্রাকৃতিক সিস্টেমের পঠন-পাঠনের উপরে যে সিস্টেমগুলো পৃথিবীর উপরিভাগে সংঘটিত হয়ে থাকে। পৃথিবীর উৎস, পঠন ও ভূমন্ডলের প্রাকৃতিক চক্রগুলো (Cycles) যেমন- পানিচক্র, কার্বনচক্র, নাইট্রোজেন চক্র কিভাবে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ক্রিয়া করে এবং বিভিন্ন প্রকার শক্তি বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ গঠন করে এ সকল বিষয় সমূহই প্রাকৃতিক ভূগোলের অংশ হিসাবে পঠিত হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক ভূগোলকে পাঁচ অংশে বিভক্ত করা হয়। যথা-

ক) ভূমিরূপ তত্ত্ব (Geomporphology)
খ) জলবায়ু বিদ্যা (Climatology)
গ) সমুদ্রবিদ্যা (Oceanography)
ঘ) জৈব ভূগোল (Bio -geography)
ঙ) মৃত্তিকা ভূগোল (Soil-geography) অথবা মৃত্তিকা বিজ্ঞান (Soil-geography)

২) মানবীয় ভূগোল (Human Geography)

ভূপৃষ্ঠে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য বিস্তারকারী শক্তি মানুষ।মানুষ মেধা ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্থল ও জল ভাগে নানা প্রকার কর্মকাণ্ড ও ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করে এবং নানা বিধ স্থাপনা নির্মাণ করে।ভূপৃষ্ঠে মানবসৃষ্ট এক সফল কর্ম ক্রিয়া ও স্থাপনা সমূহের পঠন-পাঠনকে মানবিক ভূগোল বলে।অন্য কথাই বলা যায় যে, ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত ফিচার (Feature) সমূহ যেগুলো সৃষ্টির পশ্চাতে মানুষের হাতের ছোঁয়া আছে যে সকল ফিচার সমূহের পঠন-পাঠনই হলো মানবিক ভূগোল।


মানবিক ভূগোল বলতে কি বুঝায় তা সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় যে, মানুষের কর্মকান্ডের উপরে ভূমি যে প্রভাব বিস্তার করে বা মানুষের কর্মকান্ডগুলো ভূমি দ্বারা যেভাবে প্রভাবিত হয় তার পঠন-পাঠনকেই মানবিক ভূগোল বলে। আধুনিক ভূগোল শাস্ত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত জার্মান ভূগোলবিদ ফ্রেডরিক রাটজেল (Freiderich Ratzal) মানবিক ভূগোল পঠন-পাঠনের প্রণালীবদ্ধ রোডম্যাপ প্রস্তুত করেন।


প্রফেসর রাটজেলের সুযোগ্য ছাত্রী মার্কিন ভূগোলবিদ ইলেন স্যাম্পেল মানবিক ভূগোলে মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃ সম্পর্ক উদঘাটন করেন।অন্যদিকে ফরাসি পন্ডিত পল ভিদাল ডি লে ব্লাচ (Paul Vidal de la Balche) এবং তার সুযোগ্য ছাত্র জি ব্রুনেস(Jea Bruhnes) মানবিক ভূগোলকে ভূদৃশ্য পরিবর্তনে মানুষের সৃজনশীলতার আলোকে বিবেচনা করেন। মানবিক ভূগোলে বিবিধ শাখায় বিভক্ত।মানবিক ভূগোল শাস্ত্রকে নিম্নলিখিত শাখাসমূহে বিভক্ত করা হয়। যথা-

ক) নৃতাত্ত্বিক ভূগোল (Anthropo Geography)
খ) অর্থনৈতিক ভূগোল (Economic Geography)
গ) কৃষি ভূগোল (Agriculture Geography)
ঘ) সম্পদ ব্যবস্থাপনা (Resource Geography)
ঙ) শিল্প কারখানা (Industrial Geography)
চ) পরিবহন ভূগোল (Transport Geography)
ছ) বসতি ভূগোল (Settlement Geography)
জ) সামাজিক ভূগোল (Social Geography)
ঝ) জনসংখ্যা ভূগোল (Population Geography)
ঞ) সাংস্কৃতিক ভূগোল (Cultural Geography)
টি) রাজনৈতিক ভূগোল (Political Geography)
ঠ)মানচিত্রাংকন ভূগোল(Cartographic Geography)

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ভূগোল এমন একটি বিষয় যার প্রতিফলন আমরা পরিবেশে দেখতে পাই। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক রূপ হিসাবে ভূগোলের ঐতিহ্য প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও অধিক। সুতরাং আজকের আর্টিকেলে ভূগোলের সংজ্ঞা দাও-ভূগোলের মূল শাখাসমূহ আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url