বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানতে চান বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বহু শিল্পের কাঁচামাল বনভূমি থেকে পাওয়া যায়। বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের শিল্পের স্থানীয়করণ সম্ভব হয়েছে। তাই বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা আলোচনা করা হলো।
বনভূমি শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অপরিহার্য।একটি দেশের সার্বিক দিক বিবেচনা করলে বনভূমি অতি গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা
বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের বৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়নে বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের বহু শিল্পের কাঁচামাল বনভূমি থেকে পাওয়া যায়। কাগজ কল, রেয়ন শিল্প, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড ইত্যাদির প্রধান ভিত্তিই হলো বনভূমি থেকে প্রাপ্ত কাঁচামাল। তাই বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্পের স্থানীয়করণ সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা
বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। নিম্নে বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা/ব্যবহার আলোচনা করা হলো:
১/কাগজ শিল্প
বাংলাদেশের কাগজ শিল্প প্রধানত বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে, রাঙ্গামাটি জেলার কর্ণফুলি পেপার মিল স্থানীয় পাহাড়ি বনাঞ্চলের বাঁশ সম্পদের প্রাচুর্যের উপর নির্ভর করে স্থাপিত হয়েছে। কারণ বাঁশ এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল।
এছাড়াও দেখা যায় সুনামগঞ্জের ছাতকে অবস্থিত কাগজ ও মন্ড তৈরির কারখানাটি এ বনাঞ্চলের বাঁশ ,বেত ও ঘাসের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।এছাড়া খুলনার অদূরে অবস্থিত নিউজপ্রিন্ট মিল নিকটবর্তী সুন্দরবনের গেওয়া কাঠের উপর নির্ভর করে স্থাপিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র নিউজপ্রিন্ট মিল
২/হার্ডবোর্ড ও পার্টিকেল
বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হার্ডবোর্ড ও পার্টিকেল বোর্ড মিল গড়ে উঠেছে। যেমন-খুলনার হার্ডবোর্ড মিল,আদমজী পার্টিকেল বোর্ড মিল, কাপ্তাই হার্ডবোর্ড মিল ও বাংলাদেশ বোর্ড মিলে কাঁচামাল হিসেবে কাঠ,শণ,পাটকাঠি,ধানের খড় ইত্যাদি ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বোর্ড ও পার্টিকেল উৎপাদন করছে।
৩/রেয়ন শিল্প
রেয়ন শিল্পও বনভূমির উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। চন্দ্রঘোনা কাগজ কলের নিকটবর্তী রেয়ন কারখানাটি স্থানীয় বনভূমির নরম কাঠ ও বাঁশের উপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয়েছে।বিশেষ করে রেয়ন উৎপাদনে এ শিল্পের বেশিরভাগ কাঁচামাল রাঙ্গামাটি বনভূমি থেকে সংগৃহীত।
৪/দিয়াশলাই শিল্প
দিয়াশলাই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল নরম কাঠ। সুন্দরবন থেকে প্রাপ্ত নরম গেওয়া কাঠ এবং অন্যান্য বনাঞ্চল থেকে প্রাপ্ত ছাতিম, শিমুল ও গেওয়া কাঠের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের দিয়াশলাই শিল্প স্থাপিত হয়েছে।
৫/ভেষজ শিল্প
বনের গাছগাছড়া, লতাপাতা, মধু ইত্যাদি কবিরাজি ওষুধ এবং অন্যান্য ভেষজ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ভেষজ গুণসম্পন্ন এবং মানুষ ও পশুর রোগ নিবারক ৪৫০ থেকে ৫০০ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা গেছে।এসব উদ্ভিদের মধ্যে উলটকম্বল,বাসক, ছাতিম, থানকুনি,মেথি,কাচি,কালো ধুতরা, শতমূলী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
৬/চেরাই শিল্প
বনজ সম্পদের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কাঠ চেরাই শিল্প গড়ে উঠেছে। বনভূমি থেকে সংগৃহীত শাল, সেগুন, মেহগনি, গামারি ইত্যাদি গাছ 'স'মিলে চেরাই করা হয়।এসব চেরাইকৃত কাঠ বিভিন্ন নির্মাণ কাজ এবং আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
৭/পরিবহন শিল্প
গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন শিল্পের উন্নতি বনজ সম্পদের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। বনভূমি থেকে প্রাপ্ত গর্জন, সেগুন, চাপালিশ ইত্যাদি কাঠ রেলগাড়ির বগি, রেল পথের স্লিপার, লঞ্চ, স্টিমার,নৌকা, বাস ও ট্রাকের বডি ইত্যাদি তৈরিতে প্রয়োজন হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের পরিবহন শিল্পের উন্নতিও বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল।
৮/চামড়া শিল্প
দেখা যায় যে,বনভূমির কতকগুলো গাছের বাকলের উপর বাংলাদেশের চামড়া শিল্প অনেকাংশে নির্ভর করে। পশুর চামড়া পাকা করার জন্য সুন্দরবনের গরান বৃক্ষের বাকল ব্যবহৃত হয়। আবার বাবলা গাছের বাকলও চর্ম শিল্পে প্রয়োজন হয়। এছাড়া চামড়া শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে বন্যপ্রাণীর চামড়া ব্যবহৃত হয়।
৯/পেন্সিল শিল্প
পেন্সিল শিল্পের প্রধান কাঁচামাল ধুন্দল গাছের নরম কাঠ। সুন্দরবনের ধুন্দল বৃক্ষের নরম কাঠের উপর নির্ভর করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পেন্সিল কারখানা গড়ে উঠেছে।
১০/বয়ন শিল্প
বয়ন শিল্পে ব্যবহৃত ববিন তৈরিতে বনজ সম্পদ ব্যবহৃত হয়।বাংলাদেশের পাট,বস্ত্র ও সুতা কলে প্রচুর পরিমাণে সুতা গুটানোর কাজে ববিনের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া বয়ন শিল্পের যন্ত্রপাতির কিছু কিছু কাঠামো নির্মাণেও বনের কাঠ ব্যবহৃত হয়।
১১/আসবাবপত্র শিল্প
বনের প্রাপ্ত উন্নত মানের কাঠের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে অনেক আসবাবপত্র শিল্প গড়ে উঠেছে। আসবাবপত্র নির্মাণে সাধারণত যেসব কাঠ ব্যবহৃত হয় সেগুলোর মধ্যে সেগুন, সুন্দরি, মেহগনি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এদেশে তৈরি আসবাবপত্র বর্তমানে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
১২/নির্মাণ শিল্প
বাংলাদেশের বনজ সম্পদ, নির্মাণ শিল্পের জন্য বিশেষ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।গৃহনির্মাণ, সাঁকো, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি, দালান কোঠার সেন্টারিং, ঘর- দরজা নির্মাণে বনজ সম্পদ ব্যবহৃত হয়।
১৩/বাঁশ ও বেত শিল্প
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের অন্যতম উপকরণ হচ্ছে বাঁশ ও বেত। এসব উপকরণ দ্বারা ফুলদানি, ছাইদানি থেকে শুরু করে খাট,সোফা,শেলফ, ঝুড়ি ও বিভিন্ন প্রকার খেলনা তৈরি করা হয়। এসব উপাদানের কিছু অংশ আবার বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।
১৪/পর্যটন শিল্প
পর্যটন শিল্পের উন্নতি বনজ সম্পদের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে অতি মনোরম পরিবেশ বিশিষ্ট বনভূমি রয়েছে সেখানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, বিশ্বের একমাত্র গরান বনভূমি সুন্দরবনকে পর্যটন শিল্প এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
১৫/রেশম শিল্প
এদেশে বনজ সম্পদের উপর রেশম শিল্প অনেকাংশে নির্ভরশীল। রেশম এদেশের একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প। বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের রেশম শিল্প রয়েছে। যথা-স্বাভাবিক রেশম শিল্প ও কৃত্রিম রেশম শিল্প। স্বাভাবিক রেশম শিল্পের একমাত্র কাঁচামাল হলো রেশম গুটি। তুঁত গাছের পাতা ভক্ষণ করে রেশম পোকা গুলো গুটি তৈরি করে।
রাজশাহী অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু তুঁত গাছ চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী বলে দেশের এ অঞ্চলেই এ শিল্পে উন্নত। আর নরম কাঠ, বাঁশ ও পরিত্যক্ত তুলা প্রভৃতি কৃত্রিম রেশম শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।তাই যেসব অঞ্চলে নরম কাঠ, বাঁশ প্রভৃতির প্রাচুর্য রয়েছে সেখানে এই শিল্প গড়ে উঠে। কৃত্রিম রেশমের পর্যাপ্ত কাঁচামালের দরুন চট্টগ্রামে বৃহদাকার কৃত্রিম রেশম শিল্পের কারখানা স্থাপিত হয়েছে।
১৬/মোম শিল্প
বনভূমি থেকে প্রাপ্ত মোমের উপর নির্ভর করে এ দেশে মোম শিল্প গড়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ ও কেরোসিনের বিকল্প হিসেবে মোম আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
১৭/চুন শিল্প
চুন শিল্পে ব্যবহার্য উপাদান হিসেবে শামুক ব্যবহার করা হয়। সাধারণত বনাঞ্চলের নদী-নালা ও খালে প্রচুর পরিমাণে শামুক পাওয়া যায়। বনভূমি থেকে প্রাপ্ত এসব শামুক চুন শিল্পের প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৮/অন্যান্য শিল্প
বনজ সম্পদের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরো কতগুলো ছোটখাটো শিল্প, যেমন- রং শিল্প, জুতার কালি শিল্প, ব্যাগ শিল্প ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বনজ সম্পদ বাংলাদেশের মূল্যবান জাতীয় সম্পদ। এছাড়াও বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।এদেশে বিভিন্ন ধরনের বৃহদাকার শিল্প এবং মাঝারি শিল্প ও কুটির শিল্প বিকাশে বনভূমি থেকে প্রাপ্ত সম্পদের ভূমিকা অসামান্য। আর এসব শিল্পের প্রধান কাঁচামাল ও সহায়ক উপকরণ হিসেবে সাধারণত বনজ সম্পদ ব্যবহৃত হয়।