পরিবেশের উপর বনভূমির প্রভাব আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি পরিবেশের উপর বনভূমির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।পৃথিবীর যে সব অংশে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য গাছপালা ঘন অরণ্যের সৃষ্টি করেছে তাকে বনভূমি বলে অভিহিত করা হয়।জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আজকের আর্টিকেলে পরিবেশের উপর বনভূমির প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
বন পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।মানুষের অতি প্রয়োজনীয় মৌলিক সম্পদ গুলোর মধ্যে বনভূমি অন্যতম।
ভূমিকা
পৃথিবী সৌরজগতের একটি গ্রহ।এটা এমন একটি গ্রহ, যেখানে অসংখ্য প্রাণ ও জীবনের বিকাশ ঘটেছে।আর এ জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটি, পানি, উদ্ভিদ, প্রাণী, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি পরিবেশের প্রধান উপাদান।মানুষসহ সকল প্রাণী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বনের উদ্ভিদ ও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির গুরুত্ব/ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পরিবেশের উপর বনভূমির প্রভাব
বন পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।তাই বলা যায় পরিবেশকে প্রাণীর বসোপযোগী করতে বনের প্রভাব অপরিসীম।নিম্নে পরিবেশের উপর বনভূমির প্রভাব তুলে ধরা হলো:
১/ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি
বনের সবুজ উদ্ভিদ প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে ত্যাগ করছে।এ জলীয় বাষ্প ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে ঘনীভবনের মাধ্যমে মেঘে পরিণত হয় এবং বৃষ্টিপাত ঘটায়।এ বৃষ্টিপাত ভূপৃষ্ঠে পতিত হওয়ার সময় বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন সাথে নিয়ে আসে।যার ফলে ভূমি উর্বর ও উৎপাদনক্ষম হয়।
২/তাপ শোষণ
বন তথা উদ্ভিদের প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বায়বীয় তাপ শোষণ করা। উদ্ভিদের পাতা, সবুজ কান্ড এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যে পরিমাণ সূর্যালোক পতিত হয়ে তাপ শক্তিতে পরিণত হয় তার এক বিরাট অংশই প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার জন্য শোষিত হয়। কাজেই উদ্ভিদ ও তার পরিবেশ অতিরিক্ত তাপের প্রভাব মুক্ত থাকে।
৩/আর্দ্রতা রক্ষা
বায়ুর আর্দ্রতা রক্ষায় সবুজ উদ্ভিদ ও বনায়নের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কেননা প্রস্বেদনের মাধ্যমে একটি বড় গাছ গরমের দিনে প্রায় ১৮১৬ লিটার পানি বাষ্পে পরিণত করতে পারে। তাই চারপাশের বায়ুকে শীতল রাখতে বন তথা গাছের ভূমিকা অসামান্য।
৪/কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ
মানুষসহ প্রায় সকল প্রাণী প্রতিনিয়ত বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করছে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করছে।বন বা সবুজ উদ্ভিদ খাদ্য তৈরির সময় প্রাণী জগতের বর্জ্য কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে উদ্ভিদ দেহে কার্বনকে আত্তীকরণ করছে।এক গবেষণায় জানা গেছে, প্রতিদিন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতি হেক্টর সবুজ ভূমি থেকে উদ্ভিদ প্রায় ৯০০ কেজি কার্বন আত্তীকরণ করছে এবং বিনিময়ে প্রায় ৬৫০ কেজি অক্সিজেন প্রদান করছে।
৫/সমভাবাপন্ন আবহাওয়া
অত্যাধিক উষ্ণ কিংবা হিমশীতল আবহাওয়া পরিবেশ তথা প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।বনের উদ্ভিদকুল চারপাশের আবহাওয়াকে এক্ষেত্রে সমভাবাপন্ন তথা প্রাণীকুলের জন্য সহনশীল করে রাখতে সাহায্য করে। সুতরাং পরিবেশের উপর সমভাবাপন্ন আবহাওয়া সৃষ্টিতে বনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
৬/ভূমি সংরক্ষণ
ভূমি সংরক্ষণে সবুজ উদ্ভিদ এবং বনায়নের ভূমিকা অতুলনীয়। বায়ু ও পানি ক্ষয়জনিত কারণে দেখা যায় প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন মাটি ভূমির উপর থেকে অপসারিত হয়।এর ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে উদ্ভিদ আচ্ছাদন বিনষ্ট হয় এবং উদ্ভিদের সহজলভ্য খাদ্য উপাদান অপসারিত হয়। বাংলাদেশ প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। অথচ দেশে পর্যাপ্ত বন ও সবুজ উদ্ভিদ থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা খুব কম থাকে।
৭/বিষাক্ত গ্যাস শোষণ
বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা,ছাই, সূক্ষ্ম ধাতু ও বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্যাস ভেসে বেড়াচ্ছে। যানবাহনের কালো ধোয়া ও শিল্প বর্জ্যই এসবের উৎস। এ বিষাক্ত উপাদান সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলীয় পরিবেশে আমরা বসবাস করছি বিধায় আজ আমরা অ্যালার্জি, ক্যান্সার সহ নানা রকমের দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছি। গাছপালা বায়ুমণ্ডলে ভেসে থাকা ধূলিকণা, ছাই ও অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদানের বেশ কিছু অংশ শোষণ করে নিয়ে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সহায়তা করে।
৮/বায়ুর গতি নিয়ন্ত্রণ
বন বা উদ্ভিদ বেষ্টনী বায়ুর গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। তবে অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের প্রভাব বেশি। সুতরাং এ অবস্থা মোকাবেলায় উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষবেষ্টনী ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতে পারে।
৯/উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি
উদ্ভিদের পাতা ও বর্জ্য পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূমির হিউমাস ও উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। কোন কোন উদ্ভিদ যেমন- (শিম্বি জাতীয় উদ্ভিদ) বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন সরাসরি মাটিতে আবদ্ধকরণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সার সংগ্রহকারীর ভূমিকা পালন করে।
১০/গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া
বন গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া রোধ করে। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির কারণে পাহাড়ে আটকে থাকা বরফের বেশ কিছু অংশ গলে যাচ্ছে এবং পানির আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশ, মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশের মতো নিম্ন সমতল ভূমির দেশগুলোর বিশাল অঞ্চল সমুদ্রের নিচে চিরতরে তলিয়ে যাবে।
এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন বনাঞ্চলে দাবানলের সৃষ্টি হবে। এ প্রেক্ষাপটে হয়তো কোন কোন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন গ্যাসের আধিক্য। এই তিনটি গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আধিক্য নিয়ন্ত্রণে রাখার অন্যতম উপায় হল বনায়ন বা বৃক্ষ সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
১১/মরুভূমির বিস্তার রোধ
বনভূমির গাছের পাতা ভূমিতে পচে ভূমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে জমিতে প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয়। এতে মরুভূমি বিস্তার লাভ করতে পারে না। সুতরাং বলা যায়, মরুভূমির বিস্তার রোধকল্পে বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম।
১২/বৃষ্টিপাত
আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে বনভূমি বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গাছপালা বেশি থাকায় সেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।আর এ বৃষ্টিপাত এদেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
১৩/প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বনভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বনভূমি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি রোধ করে থাকে। এতে মানুষের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। বিশেষ করে সমুদ্রোপকূলীয় বনভূমি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি ও সম্পদাদি রক্ষা করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
১৪/বন্যা নিয়ন্ত্রণ
বনভূমি বন্যার প্রকোপ কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশে যে পরিমাণ বনভূমি প্রয়োজন সে তুলনায় বনভূমির পরিমাণ কম। তবে বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারলে বন্যার প্রকোপ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সুতরাং বলা যায় যে, বনভূমি বন্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, বনভূমির প্রভাবেই পরিবেশ নির্মল ও প্রাণীর বাসোপযোগী হয়ে উঠে।কিন্তু বনভূমির অভাবে পরিবেশ হয়ে পড়ে মরুময় এবং বসবাসের অনুপযোগী। সুতরাং পরিবেশের উপর বনভূমির প্রভাব অপরিসীম। উদ্ভিদ ও প্রাণী পরিবেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ উদ্ভিদ ও প্রাণীকে বিভিন্ন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বনভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।পরিবেশের উপর বনভূমির প্রভাব আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।