গ্রামীণ বসতির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে আপনাদের গ্রামীণ বসতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানোর চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।

গ্রামীণ বসতির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর
সাধারণত বলা যায় যে,প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মকান্ডের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী গ্রামীণ বসতি গড়ে তোলে। গ্রামীণ বসতির বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হলো:

ভূমিকা

গ্রাম হচ্ছে ছোট একটি অঞ্চলে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের এক বসতি, যাদের মূল পেশা চাষাবাদ। আর কৃষিই হলো তাদের জীবনধারা। তবে এটি নিশ্চিত যে, গ্রামই হলো সব থেকে প্রাচীন ও স্থায়ী মানবগোষ্ঠী।আর এ প্রাচীন মানব গোষ্ঠীর তথা গ্রামীণ বসতির কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে যা অন্যান্য বসতি থেকে এটিকে আলাদা করেছে।

গ্রামীণ বসতি

সাধারণত যে বসতি গুলোর অধিকাংশ মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত থাকে তাকে গ্রামীণ বসতি বলে। গ্রামীণ বসতির অধিবাসীরা প্রধানত কৃষিকার্য, পশুপালন, মৎস্য শিকার, মৎস্য চাষ, বনজ সম্পদ আহরণ ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত থাকে। তাদের জীবিকা নিতান্তই ভূমিনির্ভর। পানির প্রাচুর্য, কৃষিযোগ্য ভূমি,গো-চারণভূমি, জ্বালানি, বাড়ি নির্মাণের উপকরণ ইত্যাদির প্রভাবে গ্রামীণ বসতি গড়ে উঠে।

গ্রামীণ বসতির সংজ্ঞা

শহর নগর থেকে অনেক দূরে যেখানে নিভৃত, কোলাহল মুক্ত,দূষণমুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে অনিবিড় ঘর-বাড়িতে বসবাসকারী স্বল্প সংখ্যক মানুষ যার অধিকাংশ কৃষির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে যে বসতি গড়ে উঠে তাকে গ্রামীণ বসতি বলে। গ্রামের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। গ্রামীণ ভূদৃশ্য অনেক খোলামেলা এবং অনিবিড় ঘরবাড়ি গুলোর চারিদিকে দিগন্ত বিস্তৃত কৃষি ভূমি প্রাধান্য লাভ করে।


গ্রামের মানুষেরা সামাজিকভাবে পরস্পর সম্পর্ক বিশিষ্ট। এখানে অর্থনৈতিক স্তর, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পার্থক্য থাকলেও কৃষক,জেলে,তাঁতি, কামার,কুমার সকলেই একই গ্রামীণ সমাজের অন্তর্গত, সামাজিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যেকেই একে অন্যের সাথী, সকলের মধ্যে সহমর্মিতা রয়েছে। একজনের বিপদে সবাই এগিয়ে আসে।

গ্রামীণ বসতির বৈশিষ্ট্য

বিশেষ কতগুলো বৈশিষ্ট্য গ্রামীণ বসতিকে বিশিষ্ট করে তোলে। তাই পৌর-গ্রামীণ বসতি আলোচনায় যত মতপার্থক্য থাকুক না কেন, গ্রামীণ বসতির কতগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা একে স্পষ্ট করে তুলতে পারে।গ্রামীণ বসতির বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো:

১/নির্দিষ্ট আবাসভূমি

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বাস করার উপযোগী নির্দিষ্ট ভূমি থাকে।এই সকল ভূমিখণ্ডকে বাস্তুভিটা বলা হয়। গ্রামীণ অধিবাসীদের কাছে এই বসতভিটার মূল্য অনেক বেশি। আর শত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কেউ এই বসতভিটার মায়া ছাড়তে রাজি নয়। অনেকেই আবার ওয়ারিশসূত্রে বাস্তু ভিটার মালিক হয়ে থাকেন।

২/কৃষিবৃত্তি

গ্রামীণ বসতির জনগণের আয়ের প্রধান উৎস হল কৃষি। অন্যান্য আনুষঙ্গিক রুজি রোজগারের উপায়ের উৎস থাকলেও সেগুলোও মূলত কৃষির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। গ্রামীণ অর্থনীতির মূল মেরুদণ্ডই হলো কৃষি।তাই বলা যায় যে, গ্রামীণ জনগণের অন্যান্য দিক ও বিষয়াদি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে।

৩/জনসংখ্যার স্বল্প ঘনত্ব

জমির উর্বরতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করেই গ্রামীণ বসতির জনসংখ্যা কম বা বেশি হয়ে থাকে। আর সাধারণত কৃষি নির্ভর জীবনযাপনে ভূমির গুরুত্ব বেশি হওয়ায় বাসস্থানের জন্য সীমিত পরিমাণের ভূমি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।সে কারণেই ভূমির তুলনায় এখানে স্বল্প সংখ্যক লোকের বাস।

৪/সমষ্টিগত চেতনা

গ্রামীণ বসতির সদস্যদের মধ্যে এক সমষ্টিগত চেতনার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর এক ঐক্যবোধ বর্তমান থাকে।গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠান বা পালা-পার্বণে সাধারণত সকলে সমবেতভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে।আর তাদের সামাজিক রাজনীতি, আচার- বিচার, প্রথা-প্রকরণ প্রভৃতি অভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। এ কারণে গ্রামীণ বসতির অধিবাসীদের মধ্যে সাধারণত এক গভীর সম্প্রীতির সৃষ্টি হয়।

৫/সরলতা

সরলতা গ্রামীণ বসতির সদস্যদের জন্য আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।তাদের জীবন ধারা সহজ, স্বাচ্ছন্দ ও শান্তিপূর্ণ। তাদের মধ্যে শঠতা বা ভনিতা থাকে না।তাদের আচার-ব্যবহার কৃত্রিমতাবর্জিত এবং স্বতঃস্ফূর্ত।তাদের নৈতিক চরিত্র উন্নতমানের।আর মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাদের মধ্যে থাকে না। আধুনিক অভিশাপ থেকে গ্রামীণ বসতির সদস্যরা মুক্ত। তাছাড়া গ্রামীণ বসতির সদস্যরা সহজ ও সরলতার পাশাপাশি মিতব্যয়ী হয়।

৬/যৌথ পরিবার ব্যবস্থা

গ্রামীণ বসতির আরেকটি অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হলো যৌথ পরিবার ব্যবস্থা।একান্নবর্তী যৌথ পরিবার ব্যবস্থার অস্তিত্ব গ্রামাঞ্চলে এখন কমবেশি বর্তমান। এর একটি বড় কারণ হলো গ্রামাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি।ফলে পরিবারের সকলেই এ চাষাবাদের সঙ্গে অল্পবিস্তর যুক্ত থাকে।স্বভাবতই এ রকম কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির কারণে গ্রামীণ বসতির সদস্যদের মধ্যে যৌথ পরিবার ব্যবস্থার প্রচলন পরিলক্ষিত হয়।

৭/ধর্মভাব

গ্রামীণ বসতির সদস্যদের মধ্যে ধর্মভাবের প্রাধান্য আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। গ্রামীণ অধিবাসীরা সাধারণত ধর্মপরায়ণ হয়ে থাকে। তাদের জীবনধারা মূলত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। গ্রামীণ বসতির জনগোষ্ঠী খামখেয়ালি আচরণকে ভয় ও ভক্তি করে।গ্রামীণ বসতির সদস্যদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অবিসংবাদিত প্রভাব প্রতিক্রিয়া অনস্বীকার্য।

৮/স্থবিরতা

গ্রামীণ বসতির সামাজিক গতিশীলতা খুব মন্থর।এছাড়া সামাজিক পরিবর্তনের ধারা এখানে খুব সহজেই ক্রিয়া করতে পারে না।তারা গতানুগতিক সামাজিক রীতিনীতি আকারে ঘরে থাকতে ভালোবাসে। এ কারণেই কোন সংস্কারমূলক কাজ করা এখানে সহজ সাধ্য নয়।কাজেই সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত দিক থেকে এক ধরনের স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয়।

৯/অন্তর্দ্বন্দ্ব

গ্রামীণ বসতিতে সৌহার্দ্য ও সহানুভূতিশীল অবস্থানের মধ্যেও অনেক সময় পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি হয়ে থাকে। অর্থসম্পত্তি, গৃহপালিত পশু ও ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এবং কথাবার্তায় অসংলগ্নতার জন্য গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় আবার এসব বিষয় নিয়ে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে।

১০/দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা

গ্রামীণ বসতির অধিবাসীদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং এক ধরনের একগুঁয়েমি ভাব পরিলক্ষিত হয়। আর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বাইরের জগতের সঙ্গে মূলত তাদের সংযোগ সম্পর্ক নেই বললেই চলে।ফলে গ্রামবাসীদের মধ্যে নিজেদের জীবনধারাগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এক দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাসের সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তারা অন্ধ ও আবেগপূর্ণ ধারণা পোষণ করে। তাই তাদের জীবনধারা সনাতন ও সুনির্দিষ্ট এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তারা অত্যন্ত গোঁড়া।

১১/বিস্তীর্ণ প্রান্তর

গ্রামীণ বসতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বিস্তীর্ণ প্রান্তর।আর এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর ভূমি প্রধানত কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়।বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে বসতি থেকে আলাদা করা যায় না। কারণ গ্রামের লোকদের এই জমিই বেঁচে থাকার প্রধান মাধ্যম।

উপসংহার

গ্রামীণ বসতির উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এগুলো শহরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পার্থক্যের সৃষ্টি করে।আর এ সকল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপাদানের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ বসতির জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক বিশেষ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই পরিবেশ গ্রামীণ বসতির অধিবাসীদের সামাজিক দায়িত্বশীলতা, জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। আর এর পরিপ্রেক্ষিতে এ বৈশিষ্ট্যসমূহ গ্রামীণ বসতিকে একটি আলাদা জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। আজকের আর্টিকেলে গ্রামীণ বসতির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে।আশাকরি আজকের আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url