মানব-পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বর্ণনা কর
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে মানব-পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশাকরি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীকে ধ্বংসের করাল গ্রাস থেকে বাঁচানো যায়।
ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তন মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর চরম হুমকির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে,তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সরাসরি জনজীবন ও পরিবেশের উপর। মানুষের নিত্যনতুন রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে, জীব প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
আরো পড়ুন:জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ্বের জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ঋতু পরিবর্তনের ফলে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। গত শতাব্দীতে এই পরিবর্তন হয়েছে খুব দ্রুত যা ক্রমেই মানব সভ্যতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেকোনো অঞ্চলের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত থাকে মানুষ। হঠাৎ ঐ আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনে মানুষ ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের সুস্থতায় যে হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে, তা আগামীতে আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ববাসী এখন সোচ্চার। উন্নত বিশ্বের শিল্পায়ন প্রসূত নির্গত গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে। ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে বাড়ছে উষ্ণতা,সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা,এর সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
জলবায়ু পরিবর্তন
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতানুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন হলো কোন জায়গার জলবায়ুর গড় অবস্থার দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন।এর ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত হতে পারে।এই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অধিক হারে কার্বন গ্যাস নির্গমন। এই কার্বন জলবায়ুর সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। ফলে অস্বাভাবিকভাবে দুই জলবায়ুর সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। ফলে অস্বাভাবিকভাবে দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।আর এভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হয়।এছাড়াও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ হচ্ছে যেমন: ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া, অপুষ্টি, পানিবাহিত রোগ, ফুসফুস ও শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা প্রভৃতি।জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা মোকাবেলায় সব সময় সচেষ্ট থাকতে হবে।
মানব-পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
১)জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ হচ্ছে যেমন: ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া, অপুষ্টি, পানিবাহিত রোগ, ফুসফুস ও শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা প্রভৃতি। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক বোঝা স্বরূপ ডায়রিয়া ও অপুষ্টি (মৃত্যুর হার ও অসুস্থতার হার) বৃদ্ধি পাবে, যা ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে, যেমন-বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, মিয়ানমার ও নেপালে ২০০০ সালে সর্বোচ্চ ছিল এবং এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালেও এ ঝুঁকি তুলনামূলক ভাবে সর্বাধিক থাকবে।
২)শহরাঞ্চলে বায়ু দূষণ ও জলবায়ুর তারতম্য বৃদ্ধির জন্য মানুষের ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। নতুন শিল্প এলাকা যেমন-চীনের চংকুইং এবং ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় বায়ুর মানের বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে এবং বায়ু মানের এই অবনতি, সম্ভবত এ অঞ্চলে দাবদাহের ব্যাপকতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং ধোঁয়াশার কারণে হৃদনালির এবং শ্বসনতন্ত্রের রোগ দেখা দিতে পারে।
৩) ম্যালেরিয়ার ধরন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কীটনাশক প্রতিরোধী এবং নির্দিষ্ট প্রকারের মশার প্রকোপ সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের পতঙ্গবাহিত সংক্রামক রোগ সমূহ যেমন-ম্যালেরিয়া, সিসটোসোমিয়াসিস, ডেঙ্গু জ্বর ও অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগসমূহ ভালোভাবে তাল মিলিয়ে নিতে পারবে।
৪)অনকোম্যালেনিয়াও জলবায়ু দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয় এবং ২৪°সে. ও ২৭°সে. তাপমাত্রায় সিসটোসোমিয়াসিসের হার সর্বাধিক হয়। ম্যালেরিয়া প্রোটোজোয়ার বংশ বৃদ্ধিতে তাপমাত্রা সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে এবং অনুকূল জলবায়ু পরিস্থিতি মশার আক্রমণ আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
৫) সাইবেরিয়ার দাবানলের কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণ মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে জানা গিয়েছে।
৬)জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দুর্যোগের ফলে ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, গাছ-পালা, ক্ষেত-খামার, বাজার ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণহানি, আহত, সম্পদ নষ্ট ইত্যাদি মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনকে চরমভাবে ব্যাহত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জরুরী সেবা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে মানুষ স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না।দুর্যোগ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রস্তুতি ব্যবস্থার উপর এগুলোর প্রভাবের তীব্রতা নির্ভর করে।
৭)জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বহুলোক বেকার হয়ে পড়ে। তাদের জন্য চাই খাদ্য। এ খাদ্য যোগাড় করতে অনেকে বেছে নেয় চুরি, ডাকাতিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
পরিবেশের উপর প্রভাব
১/ইকোসিস্টেমের ভারসাম্যহীনতা
দুর্যোগের কারণে অনেক সময় প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।যেমন-আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল ওজোনস্তরের ক্ষতিগ্রস্ততা ইত্যাদি এ ভারসাম্য হীনতার জন্য দায়ী।
২/বনভূমি ধ্বংস
দুর্যোগের ফলে বনভূমির যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারে। যেমন-টর্নেডো,সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস,আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও দাবানলের ফলে বনভূমি ধ্বংস হতে পারে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে হাজার হাজার একর বনভূমি পুড়ে যায়।১৯৪৯ সালে লেডস মাউন্টেইন বনভূমিতে যে দাবানল ছড়িয়ে পড়ে তাতে ২,৫০,০০০ একর (১০৪০ বর্গ কিলোমিটার) বনভূমি পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়।
৩/বন্যপ্রাণী ধ্বংস
সুনামি, দাবানল ইত্যাদি দুর্যোগের ফলে বন্যপ্রাণী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বনভূমিতে নানা প্রজাতির প্রাণী বাস করে। দুর্যোগের কারণে এসব প্রাণী মারা যায় কিংবা এসব প্রাণীর খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
৪/মৎস্য প্রজাতির ক্ষতি
অনেক সময় দুর্যোগের কারণে মৎস্য প্রজাতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাম্প্রতিক সুন্দরবনের শ্যাওলা নদীতে তেলের ট্যাংকার দুর্ঘটনা ঘটলে আশেপাশের ১০০ বর্গমাইল এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে।এতে সুন্দরবনের একটি বড় অংশ মৎস্য প্রজাতির অনেক ক্ষতি হয়।
৫/কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি
দুর্যোগের কারণে অনেক সময় বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যেমন-অগ্নিকাণ্ড বা দাবানলের কারণে অথবা শিল্প দুর্ঘটনার কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেতে পারে।
৬/সুনামি সৃষ্টি
সুনামি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই এটি সৃষ্টি হয়। সাধারণত ভূমিকম্প,সাগরের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত কিংবা টেকটোনিক প্লেটের নড়চড়ের ফলে সুনামির সৃষ্টি হয়। সুনামি উপকূলবর্তী এলাকায় ১০০ ফুটের বেশি উঁচু হয়ে সাগরের ঢেউ আঘাত হানতে পারে।
৭/বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া
অনেক সময় দুর্যোগের কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যেতে পারে।দাবানলের কারণে কোন এলাকার বৃক্ষরাজি ধ্বংস হলে সে এলাকায় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮/ভূমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি
দুর্যোগের কারণে বিশেষ করে সুনামি বা জলোচ্ছ্বাসের কারণে খাবারের লবণাক্ত পানি উপকূলীয় এলাকায় ভূমিতে প্রবেশ করে। এতে ভূমির লবণাক্ততা বেড়ে যায় এবং মিঠা পানির মাছ ও ফসলের ক্ষতি হয়।
৯/নদী ভাঙ্গন
নদী ভাঙ্গন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ।নদী ভাঙ্গনের জন্য অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দায়ী। যেমন-প্রচন্ড বন্যা, ভূমিকম্পের ফলে নদীর গতিপথের পরিবর্তন ইত্যাদি।
১০/সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা
দুর্যোগের বৃদ্ধি কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি জলোচ্ছ্বাসের কারণে সামাজিক ভাবে হতে পারে, হিমালয় ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার কারণে স্থায়ি ভাবেও হতে পারে।
১১/মাটি, বায়ু ও পানি দূষণ
প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট উভয় দুর্যোগের কারণেই মাটি, বায়ু ও পানি দূষণ ঘটে থাকে। শিল্প দূর্ঘটনা, শিল্প বর্জ্য, বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, তেলের খনি ও কয়লা খনি দুর্ঘটনা, পারমাণবিক দুর্ঘটনা, গ্যাস দুর্ঘটনা ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ফলে মাটি, বায়ু ও পানি দূষণ ঘটে থাকে।
১২/নদীর গতিপথের পরিবর্তন
অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নদীর গতি পথের পরিবর্তন ঘটে।বাংলাদেশের বর্তমানে যমুনা নদীর যে গতিধারা দেখা যায়, তা মাত্র দু'শত বছর পূর্বে সৃষ্ট ভূমিকম্পের ফল।
১৩/অস্বাভাবিক বন্যা
দুর্যোগ জনিত কারণে অস্বাভাবিক বন্যা দেখা দিতে পারে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারালে অস্বাভাবিক বন্যা দেখা দিতে পারে।
১৪/গ্রিন হাউস ইফেক্ট
দুর্যোগের কারণে গ্রিন হাউস ইফেক্ট দেখা দিতে পারে। মূলত বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস বৃদ্ধিই এর জন্য দায়ী।
শেষ কথা
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে নদ-নদী শুকিয়ে যেতে পারেি।আবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া, নদীর গতিপথের পরিবর্তন, বন্যা কমে যাওয়া ও মরুকরণ, প্রক্রিয়া জনিত কারণে নদী শুকিয়ে যেতে পারে।আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে অধিক সচেতন হতে হবে। আজকের আর্টিকেলে মানব-পরিবেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বর্ণনা করা হয়েছে।আশাকরি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।