বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে আপনাদের বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে এ যাবৎকালে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে।কারণ এর ক্ষয়ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ অনেক বেশি হয়ে থাকে।সমগ্র বিশ্বে এটি মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। প্রতিবছর বন্যার কারণে বিপুল সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়। বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর বন্যা সংঘটিত হয় বলে বিশেষজ্ঞরা জোরালো মত প্রদর্শন করেন। তবে যে কারণেই বন্যা সংঘটিত হোক না কেন এটি যে মানুষের জীবনের চরম ভোগান্তি বয়ে আনে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব বর্ণনা কর
বাংলাদেশে বন্যা সমগ্র প্রাণীজগতের জন্য দুঃখ-দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসে।বন্যা এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগ ব্যাধির বিস্তারসহ,অবকাঠামোগত ধ্বংস সাধন এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয় সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

ভূমিকা

বন্যা বলতে সাধারন অর্থে নদী, খাল বা বিলে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে অধিক পানি প্রবাহকে বুঝায় যা পার্শ্ববর্তী এলাকাকে প্লাবিত করে। বন্যায় নিম্ন ভূমি পানিতে ডুবে যায়। সাধারণত নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। নদী,খাল,বিল প্রভৃতির পানি ধারণের নিজস্ব ক্ষমতা বা সীমা থাকে। এ সীমার অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে নদী, খাল, বিল প্রভৃতি ছাপিয়ে পানি প্লাবনমুক্ত ভূমি তথা শুকনো ভূমিতে প্রবাহিত হয়।


এর ফলে ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ, বনভূমি প্রভৃতি পানিতে ভরে যায়।পানির এরূপ চরিত্রকে বন্যা বলা হয়। বিশ্বে প্রতি বছর বন্যা আঘাত হানে। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। বন্যা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যাকে নিয়ে গবেষণার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ বন্যা সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা পরিচালনা করছেন।এছাড়াও বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ বিভিন্নভাবে বন্যাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ Chow(১৯৫৬) বন্যা বলতে বুঝিয়েছেন, "বন্যা তুলনামূলকভাবে উচ্চতর প্রবাহ যা পানি প্রবাহের প্রাকৃতিক চ্যানেলের পাড় প্লাবিত করে।"

পানি বিজ্ঞানী Word বলেন, "বন্যা হলো পানি প্রবাহ,যা স্বাভাবিক অবস্থায় প্লাবন মুক্ত এমন ভূমিকে প্লাবিত করে।

Rostredt এর মতে, "বন্যা হলো অস্বাভাবিক প্রবাহ,যা প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পানি প্রবাহের চ্যানেল প্লাবিত করে।"

উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, বন্যা হলো এমন অবস্থা যা উচ্চতর পানি প্রবাহের মধ্য দিয়ে প্লাবনমুক্ত ভূমিকে প্লাবিত করে দেয়। নদী,খাল ও বিলের ন্যায় সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির ফলেও বন্যার সৃষ্টি হয়। ফলে উপকূলবর্তী এলাকা পানিতে ডুবে যায়।

বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব

বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আর বন্যা বাংলাদেশের একটি অতিপরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ।এ দুর্যোগটি যে সমস্ত প্রভাব বিস্তার করে সেগুলো নিম্নরূপ:

১/সম্পদ হানি

বাংলাদেশে সৃষ্ট প্রতিটি বর্ণনায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ হানি ঘটে। বন্যার পানি মাঠ-ঘাট, ঘরবাড়ি, হাট-বাজার প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। এছাড়া ফসল, গবাদি পশু, ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট প্রভৃতি ক্ষতিসাধন বন্যার সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সম্পর্কযুক্ত।

২/উৎপাদন হ্রাস

বন্যার পানিতে মাঠ-ঘাট,হাট-বাজার, শহর-গঞ্জ প্রভৃতি ভেসে যায়। ফলে বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ক্ষতির সম্মুখীন হয়।ফলে সামগ্রিক উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পায়।

৩/দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি

বন্যার কারণে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার ফলে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বন্যার পানিতে ফসলের মাঠ ভেসে যায়, যা কৃষি ফসল সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দেয়।দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যায় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।আর বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। তবে বন্যার সময় সম্পদ হারিয়ে, তারা আরও দারিদ্র্যে পরিণত হয়।দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের সমস্যাকে আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দেয়।

৪/উদ্বাস্তু সৃষ্টি

বন্যার ফলে বাংলাদেশে বহু মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। বন্যার সৃষ্ট নদী ভাঙ্গনে বহুসংখ্যক ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একইভাবে মানুষ চাষের জমি ও অন্যান্য সম্পদ (যেমন-বনভূমি) হারিয়ে ফেলে এবং উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে বন্যাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবছর উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে।

৫/অপুষ্টি

বন্যার ফলে খাদ্য সামগ্রীর উৎপাদন ও প্রাপ্যতা কমে যায়। সাধারণ মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা অপুষ্টিতে ভোগে। আর এভাবে বন্যা বাংলাদেশে অপুষ্টির হার বৃদ্ধি করে।

৬/দারিদ্র্য বৃদ্ধি

বন্যা বাংলাদেশে দারিদ্র্যের প্রকোপ বৃদ্ধি করে। বন্যা একদিকে যেমন বিপুল সম্পদের হানি ঘটায়, তেমনি বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগ- ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, যা মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ অনেক সময় তাদের পূর্বের পেশায় ফিরে আসতে পারে না। আর তারা বন্যার ফলশ্রুতিতে আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে এবং অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হয়।

৭/অপরাধ বৃদ্ধি

বন্যার ফলে বাংলাদেশের মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। এইসব অসহায় মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটনের ক্ষেত্রে পিছপা হয় না। সমাজে মাদক, চোরাচালান, খুন, সন্ত্রাস, ছিনতাই, পতিতাবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

৮/রোগ-ব্যাধির বিস্তার

বাংলাদেশে বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময় বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটে। বন্যার পানিতে বিভিন্ন দ্রব্য পচে চারপাশের পরিবেশে রোগ ব্যাধির বিস্তার ঘটায়। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেক মানুষ বিভিন্ন স্থানে অরক্ষিত পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হয়। ফলে তারা সহজেই বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ডায়রিয়া, কলেরা,চোখ উঠা, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটে।

৯/শহরে জনচাপ বৃদ্ধি

বাংলাদেশে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ শহরে চলে আসে জীবন ও জীবিকার খোঁজে। তারা শহরের জনচাপ বৃদ্ধি করে।শহরে এসে তারা সাধারণত খোলা আকাশের নিচে, বস্তিতে, রাস্তার পাশে প্রভৃতি স্থানে বসবাস করে এবং নতুন বস্তি গড়ে তোলে।বাংলাদেশের শহরগুলোর অধিক সংখ্যক বস্তিবাসী খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী বন্যাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। এ জনগোষ্ঠী শহরে জনচাপ বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে।

১০/পারিবারিক ভাঙ্গন

বন্যার ফলে বহুসংখ্যক মানুষ রোগ ব্যাধি,সাপের কামড় সহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুবরণ করে।আর পরিবারের কোন সদস্যের মৃত্যুতে গোটা পরিবারে অনিশ্চয়তা চলে আসে। স্বামীর মৃত্যুতে অনেক মহিলা বিধবা হয়ে যায়। পিতা- মাতার মৃত্যুতে শিশুরা হয়ে পড়ে অসহায়। পারিবারিক জীবনে নেমে আসে বিষাদের ঘন ছায়া।

১১/যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন

বন্যার ফলে বাংলাদেশের অনেক জনপদ প্লাবিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সমস্ত এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে বন্যা, প্লাবিত এলাকার মানুষ দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়।

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বন্যার সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি।বন্যার কুফল সমূহ মানব জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি সমগ্র প্রাণীজগতের জন্য দুঃখ-দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসে। তাই বন্যা প্রতিরোধকল্পে জনগণ ও সরকারকে সম্মিলিত ভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশে বন্যার প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url