বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো সম্পর্কে জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।আর বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান একান্ত আবশ্যক।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো আলোচনা কর
আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই আর্টিকেলটি না টেনে সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।

ভূমিকা

বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।এদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪২% এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে জনবসতির ঘনত্ব প্রায় ৯৫৩ জন।এ অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।আর তাই ব্যাপক হারে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এদেশের জন্য অত্যাবশ্যক।


জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এর স্থান তৃতীয়। আর জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র হলেও আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান নব্বইতম।ফলে এদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে বেশি। ক্রমবর্ধমান এ অধিক জনসংখ্যার জন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করছে।তাই বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান একান্ত আবশ্যক। নিম্নে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায় বর্ণিত হলো:

বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়

বর্তমানে জনসংখ্যার সমস্যা বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বর্তমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০২৬ সালে জনসংখ্যা ১৯.৮২ কোটি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই দেশকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে জনসংখ্যা সমস্যার আশু সমাধান একান্ত প্রয়োজন।নিম্নলিখিত উপায়ে এদেশের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

১) কৃষির আধুনিকীকরণ

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ।এদেশের কৃষি নির্ভর অশিক্ষিত মানুষ প্রাচীনতম কৃষি পদ্ধতিকে আঁকড়ে ধরে আছে।তাদের বিশ্বাস, কৃষির উন্নতির জন্য অধিক লোক প্রয়োজন। আর তাদের এ ভুল বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে কৃষির আধুনিকীকরণ করে যান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করতে হবে এবং তাদের বুঝাতে হবে যে,যন্ত্রের মাধ্যমে অল্প লোকের দাঁড়ায় অধিক কাজ করা সম্ভব।

২) শিল্পোন্নয়ন

শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য অধিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পের সম্প্রসারণ হলে দেশের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূর হবে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। আর তখন তারা অধিক সন্তান উৎপাদনকে ইতিবাচক মনে করবে না।

৩) শিক্ষাবিস্তার

বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধানকল্পে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।এতে শিক্ষিত জনগণ জনসংখ্যা সমস্যা উপলব্ধি করে নিজেদের পরিবার ছোট রাখতে সচেষ্ট হবে।

৪) সচেতনতা বৃদ্ধি

আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। তাদের উপযুক্ত বয়সে বিবাহ করা এবং পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করা,বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, বহুবিবাহে নিরুৎসাহিত করা, সংযম প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করে তুলতে পারলে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।

৫) জন্মনিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে এটি বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আর জনসংখ্যাধিক্য এমন একটি সমস্যা যাকে শুধু মাত্র জনসচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু এ সমস্যা যদি একবার প্রকট আকার ধারণ করে তাহলে এটি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এমতাবস্থায় পরিবার পরিকল্পনাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান করার জন্য সরকার পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির উপর গুরুত্বারোপ করেছে। তাই জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।

৬) জাতীয় আয়ের সুসম বন্টন

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায় হল জাতীয় আয়ের সুসম বন্টন।আর জাতীয় আয় যদি কিছু সংখ্যক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে তাহলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না, মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যায় এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। তাই জাতীয় আয়ের সুসম বন্টন নিশ্চিত করতে পারলে জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে এবং জনসংখ্যা সমস্যাও হ্রাস পাবে।

৭) আন্তর্জাতিক স্থানান্তর

বাংলাদেশের জনসংখ্যাধিক্য রোধকল্পে বিদেশে মানব সম্পদ স্থানান্তরের মাধ্যমে এ সমস্যার কিছুটা সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অভিবাসন আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে বিদেশি নাগরিকদের সংশ্লিষ্ট দেশে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

৮) বিনোদনের ব্যবস্থা

মানুষ অবসর সময়ে আমোদ-প্রমোদ করতে চায়। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে আমোদ- প্রমোদের ব্যবস্থা নেই বলে বিবাহিত জীবনকেই সেখানকার লোকেরা উপভোগের একমাত্র উপায় হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।তাই গ্রামাঞ্চলে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। আর অধিক আমোদ-প্রমোদে অংশ নিয়ে ঘরের বাইরে বেশি রাত পর্যন্ত থাকলে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের প্রবণতা অনেক কমে যায়। ফলে জন্মহার স্বাভাবিকভাবে কমে আসে।

৯) জনসংখ্যার সুসম বন্টন

সুসম বন্টনের মাধ্যমেও বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।বাংলাদেশে সর্বত্র জনসংখ্যার ঘনত্ব সমান নয়।আর কোনো কোনো স্থানের লোকবসতি অত্যন্ত নিবিড়,আবার দেখা যায়, কোনো কোনো স্থানে বিরল জনবসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে।আর যেখানে লোকবসতি বিরল তথা প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ভাবে সদ্ব্যবহার করা যায় না।অপরদিকে,ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল/ এলাকায় মানুষের উৎপাদিকা শক্তি কম হয়।


২০০১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকা জেলায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৫,৮৮৭ জন,কুমিল্লা জেলায় ১,৪৮৮ জন, চট্টগ্রাম জেলায় ১,২৩৯ জন ও বান্দরবান জেলা ৬৭ জন লোক বাস করে। আর বর্তমানে ২০২৫ সালে এর ঘনত্ব অনেক বেশি। এমতাবস্থায় অত্যাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকা থেকে বিরল বসতি পূর্ণ এলাকায় লোকজন স্থানান্তর করে বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে।

১০) আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

বাংলাদেশের অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগণের মন-মানসিকতা, অভ্যাস পরিবর্তনের লক্ষ্যে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা,বহুবিবাহ প্রতিরোধ ও অধিক সন্তান জন্মদান রোধের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন এবং এর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে জনসংখ্যা রোধ করা সম্ভব।

১১) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

দেশের সরকারি প্রশাসনযন্ত্র স্থিতিশীল ও গতিশীল এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকলে সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করা যায়।

১২) অর্থনৈতিক উন্নয়ন

বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের একটি অন্যতম প্রধান উপায় হলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতি লাভ করতে পারলে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। এতে মোট জাতীয় আয় এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে।ইতোমধ্যে সরকার কৃষি উন্নয়নের জন্য বৈপ্লবিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।আর অর্থনীতির অন্যান্য কর্মক্ষেত্র গুলো উন্নয়নে সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

১৩) কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি

সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন বহুবিধ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে জনসংখ্যার সমস্যা কিছুটা দূর করা সম্ভব হবে।আর এ লক্ষ্যে কৃষি বহির্ভূত কর্মসংস্থান; যেমন-কুটির শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে এদেশের জনগণের উপার্জন বৃদ্ধি করে জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা যায়।

১৪) নৈতিক চরিত্র গঠন

রিপুর তাড়নায় যুবক-যুবতীরা যাতে অযাচিত সন্তানের জন্ম না দেয় সেজন্য তাদের নৈতিক চরিত্র গঠন করতে হবে।অশালীন চলচ্চিত্র,গান-বাজনা,পশ্চিমা উগ্র সংস্কৃতি থেকে বিরত থাকার জন্য তাদেরকে পরামর্শ দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব।

১৫) নারী ও শিশুদের সুন্দর জীবনবোধ

আমাদের দেশে নারী ও শিশুদের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে পারলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা কার্যকর হবে। ফলে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রশমিত হবে যা জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে।

১৬) পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা

ব্যক্তি, দল, সমাজ এবং সমষ্টিগতভাবে জনসংখ্যা নীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখার জন্য পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ফল ভোগ করতে পারে।

উপসংহার

সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অধিক জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এছাড়া দুইয়ের অধিক সন্তান জন্মদানের উপর কর আরোপ, এক বা দুই সন্তানের জনকদের চাকরি বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান, অধিক জনসংখ্যার কুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে অধিক কার্যকর করার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url