পরিবেশ পরিবর্তনের কারণ সমূহ বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণ সমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভূগোলে যে সকল বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করার প্রয়াস চলছে তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে পুরাতন হলো ভূগোল ও পরিবেশের সম্পর্ক।

পরিবেশ পরিবর্তনের কারণ সমূহ বর্ণনা কর

কিভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশকে সম্পদ উৎপাদনের উপযোগী রাখা যায় পরিবেশ পাঠ সে সম্পর্কে উপায় নির্দেশ করে।

পরিবেশ পরিবর্তনের কারণ

পরিবেশ সর্বদা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য সৃষ্ট দুই কারণে ঘটে।

প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশের পরিবর্তন

প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, উদ্ভিদ, জীবজন্তু প্রভৃতি। প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিবর্তন ঘটে চলেছে সৃষ্টির আদি পর্ব থেকেই।

ক) মহাদেশগুলোর অবস্থান পরিবর্তন

প্রায় ২৮ থেকে ৩৪ কোটি বছর আগে মহাদেশগুলো একত্রে ছিল। পরে মহাদেশীয় পাতগুলো খন্ড খন্ড হয়ে চলতে শুরু করে এবং মহাদেশগুলোর অধিকাংশই পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়।

খ) ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন

সমুদ্র থেকে ভূ-আন্দোলনের ফলে ভূমিরূপ উত্থিত হয়ে পর্বত মালভূমি গঠন করে। এরপর ক্ষয়চক্র শুরু হয় এবং ক্ষয়চক্রের শেষে উচ্চভূমি একটি নিম্ন সমপ্রায় ভূমিতে পরিণত হয়।

গ) জলবায়ুগত পরিবর্তন

পৃথিবীর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে হিম যুগের আবির্ভাব ঘটে। তখন পৃথিবীর বেশিরভাগ অঞ্চলে বরফে ঢাকা পড়ে যায়। বর্তমানে বায়ু দূষণের ফলে জলবায়ু উষ্ণতর হয়ে পড়ছে।

ঘ) উদ্ভিদজাত পরিবর্তন

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জেগে উঠা ভূমিতে প্রথম জন্মায় তৃণ, এরপর গুল্ম ও জঙ্গল এরপর অরণ্য। পরে আবার তা প্রাকৃতিক কারণেই বিনষ্ট হতে পারে। নতুন জেগে ওঠা দ্বীপ ভূখন্ডে একইভাবে ঘটে উদ্ভিদ জগতের বিবর্তন।

মনুষ্য সৃষ্ট কারণে পরিবেশের পরিবর্তন

মানুষ যত সংস্কৃতিবান হয়েছে ততই সে নতুন নতুন প্রযুক্তি হাতে পাচ্ছে এবং জনসংখ্যা যত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রকৃতিও ততই সম্পদ আহরণের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে।এর অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি পরিবেশে উল্লেখনীয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে। নিচে এগুলোর আলোচনা করা হলো:

ক) অরণ্য সম্পদ সংগ্রহ ও পরিবেশ পরিবর্তন

সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি ও বসতি বিস্তারের ফলে অরণ্যের সংকোচন শুরু হয়। অরণ্য কেবল কিছু মনুষ্য গোষ্ঠী বা পশুপাখির আশ্রয়স্থল নয়, অরণ্যের ব্যবহার কেবল জ্বালানি বা আসবাবের কাঠ সরবরাহে সীমিত নয়।কাগজ,কৃত্রিম রেশম বা রেয়ন,পরিবহনযান নির্মাণসহ বহুমুখী উদ্দেশ্যে অরণ্যের অতি ব্যবহার ও অবৈজ্ঞানিক ব্যবহার জনিত বিনাশ ঘটে চলেছে। ক্ষতি হচ্ছে সামগ্রিক পরিবেশের ও বাস্তুতন্ত্রের।বিরল প্রজাতির অনেক বৃক্ষ প্রাণী বিলুপ্ত প্রায়।বিনষ্ট হচ্ছে আরণ্যক জীব কুলের একমাত্র আশ্রয়স্থল।

খ) কৃষিকার্য ও পরিবেশ পরিবর্তন

কৃষিকার্য পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের উপজীবিকা।আর পৃথিবীর সামগ্রিক ভূমি ব্যবহারের অধিকাংশ কৃষিকার্যের অন্তর্ভুক্ত। আর তাই কৃষিকার্যে ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ব্যাপকতর প্রভাব ফেলছে।
  •  আরণ্যকভূমি পরিষ্কার করে কৃষিকার্যের সম্প্রসারণের জন্য অরণ্যের বাস্তুসংস্থানে বিঘ্ন ঘটে।
  •  ফসলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভূমিভাগের অতিরিক্ত কর্ষণে ভূমিক্ষয় ঘটে।
  •  ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যবহারে ভূমির স্বাভাবিক উর্বরা শক্তি বিঘ্নিত হয়।
  •  সার, বৃষ্টি বা সেচের পানি ধুয়ে নিকটস্থ জলাশয়ে গিয়ে পড়ে।এতে জলজ উদ্ভিদের অতিরিক্ত বাড়-বাড়ন্ত ঘটে। ফলে জলাশয়ের বাস্তুসংস্থান বিঘ্নিত হয়।
  •  কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ভূমি ও জলাশয়ের প্রাণী, জীবাণুসহ শস্যখাদক পক্ষীকুলের পক্ষেও তা ভয়ানক বিপদজনক হয়ে পড়ে।DDT কয়েক প্রকার প্রজাতির পাখিকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।
  •  অতিরিক্ত সেচ খাল খননের ফলে নদীর জলে টান পড়ে। সেচের জন্য বাঁধ দেবার ফলে নদী অববাহিকার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়।
  • গভীর নলকূপ দ্বারা অতিমাত্রায় ভৌমজল টেনে তোলার ফলে পানীয় জলের ঘাটতি ঘটে এতে গ্রামাঞ্চলে আর্সেনিকের মতো জল দূষণের সমস্যা দেখা দেয় ও ভৌমজস্তর নেমে যায়।

গ)জলাভূমিতে হস্তক্ষেপ এবং পরিবেশ পরিবর্তন

বর্তমানে দেখ যায় অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা ও তাদের জন্য বাসস্থান ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তার জন্য জলা ভূমিগুলোকে ভরাট করা হচ্ছে প্রধানত ১)পৌরাঞ্চলের বহির্মুখী সম্প্রসারণের জন্য এবং ২)পৌরাঞ্চলের অধিবাসীদের সবজি, দুধ ইত্যাদির দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে। এই সকল উদ্দেশ্যে জলাভূমির আয়তন সংকোচন এবং জলাভূমিকে মাছ চাষের জন্য অবৈজ্ঞানিকভাবে বেড়িতে রূপান্তর করার ফলে জলের ও জলজ প্রাণীর স্বাচ্ছন্দ বিচরণ বাধা প্রাপ্ত হয়। এতে জলাভূমির বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হয়।

ঘ) নদীর জলপ্রবাহে হস্তক্ষেপ ও পরিবেশ পরিবর্তন

নদীগুলো বর্তমানে বেশি মাত্রায় পৌর ও শিল্পজ দূষিত জল নির্গমন এবং আবর্জনা নিক্ষেপের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।এর ফলে নদীর পানি ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়ছে। এটি নদীর জলজ প্রাণী এবং নদীর পানি ব্যবহারকারী মানুষ উভয়ের পক্ষেই বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে।

ঙ) খনিজ সংক্রান্ত কাজকর্ম এবং পরিবেশ পরিবর্তন

শিল্পায়নের প্রয়োজনে নিত্য নতুন খনিজ অঞ্চলের আবিষ্কার এবং এই খনিজ উত্তোলনের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।১) বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খনিজ সংক্রান্ত কার্যকলাপ গড়ে তোলা, বসতি ও রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যাপক অরণ্য ছেদন করতে হয়। ২) খনিজ উত্তোলন কালে সৃষ্ট ধুলো,খনিজ চূর্ণ বায়ুতে মিশে নিকটস্থ সংলগ্ন অঞ্চলের কৃষি ভূমতে ছড়িয়ে পড়ে ও ভূমির ক্ষতি সাধন করে। এটি মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষেও বিপদজনক হয়ে ওঠে। দেখা যায় সিলিকোসিস,অ্যাসবেস্টোসিস এর মতো প্রাণঘাতী ব্যাধি। ৩) খনিজ অঞ্চলের তরল বর্জ্য জল দূষণ ঘটায়। ৪) ভূমি ভাগ বসে গিয়ে বিপর্যয় ঘটা খনিজ অঞ্চলের একটি স্বাভাবিক সমস্যা।

চ) নগরায়ন ও পরিবেশে প্রভাব

প্রতিটিদেশে পৌর সভ্যতার বৃদ্ধি ও বিকাশ অনিবার্যভাবে ঘটে চলেছে।আর নগরায়ন জনজীবনে বহুবিধ সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করে। কিন্তু বহু দেশেই পৌর সভ্যতার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় জল ও বায়ু দূষণ, বহু যত্রতত্র আবর্জনা ও জঞ্জালের স্তুপ, উন্মুক্ত জমির দুষ্প্রাপ্যতা এবং তা এড়াতে নিকটবর্তী অরণ্য ও জলাভূমির ভরাট বা সংকোচন।এছাড়া সড়ক ও পয়প্রণালীর অপ্রতুল্য তার জন্য রাস্তাঘাটে যানজট, বর্ষার জল জমার মতো সমস্যাতো রয়েছেই।

ছ) শিল্পায়ন ও পরিবেশে প্রভাব

বর্তমান সভ্যতা শিল্পভিত্তিক।সুতরাং বলা যায় সব দেশেই শিল্পায়নে সচেষ্ট। আর শিল্পায়নের প্রভাব অনিবার্যভাবে পরিবেশে পড়ে। শিল্পায়নের প্রয়োজনে অরণ্য, কৃষি ও বসতযোগ্য জমি এমনকি জলাভূমির সংকোচন ঘটান হয়। শিল্পায়নের ফলে ঘটে বায়ু, জল, মৃত্তিকা ও শব্দ দূষণের মতো সমস্যাগুলো।

শেষ কথা

প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ থেকে সম্ভবত বিরত থাকা, যেমন-নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস, বাঁধ জলাধার নির্মাণ করে নদী প্রবাহে হস্তক্ষেপ করা, অ-জৈবপচনযোগ্য বস্ত ব্যবহার না করা এবং পতিত জলাভূমি ভরাট করা ইত্যাদি কারণে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করা প্রভৃতির কুফল সম্পর্কে সচেতন হওয়া। সুতরাং আজকের আর্টিকেলে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণ সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url