জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয় আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয় কি জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা আজকের আর্টিকেলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে কিভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা সম্ভব হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয় আলোচনা কর
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পুরো বিশ্বকে একত্রিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

ভূমিকা

সাধারণত গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে যে ক্রমশ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই জলবায়ু পরিবর্তন। সূর্যের আলো পৃথিবীর তাপমাত্রার প্রধান এবং একমাত্র উৎস। এজন্য সৌরশক্তির বিকিরণ জনিত তাপ শক্তির যোগান এবং উৎপাদনের ভারসাম্যের উপর পৃথিবীর গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এ কারণেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্ভাব্য উপায়সমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো:

১) ব্যাপক বৃক্ষনিধন রোধ করতে হবে।

২) সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বনায়ন করতে হবে।

৩) সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে হবে

৪)সুপরিকল্পিতভাবে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে

৫)এয়ারকন্ডিশনার এবং রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার কমিয়ে CFC নিঃসরণ কমাতে হবে।

৬)কারখানা ও যানবাহনের গ্যাস নির্গমনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।

৭)পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।

৮)সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

৯)সর্বক্ষেত্রে জ্বালানি সাশ্রয়ী হতে হবে।

১০)শিল্প বর্জ্য পুনরায় বিশুদ্ধকরণ করতে হবে।

১১)কৃষিতে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।

১২)পরিত্যক্ত জলাধার সংস্কার করতে হবে যাতে করে সেখান থেকে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন না হয়।

১৩)আবর্জনা ও মলমূত্র যথার্থ ব্যবহারের জন্য অবশ্যই বায়োগ্যাস প্লান্টের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।যেন গ্যাসের ও সারের সরবরাহ পাওয়া যায় আবার বাতাসেও গ্যাস মিশে না যায়।

১৪)বৃষ্টির পানি ধারণ, পানি সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ কৌশল রপ্ত করা।ব্যবহৃত পানি পুনরায় ব্যবহার করা।লবণাক্ততা দূরীকরণ, পানির ব্যবহার ও সেচে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

১৫)চারা রোপনের সময় নির্ধারণ করা, শস্য বৈচিত্র্য; ভূমি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন,যেমন-বৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা।

১৬)পুনর্বাসন; ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধক্ষম বসতি ও মাছ ধরার নৌকার কাঠামো উন্নয়ন ও স্থায়ীত্বশীল বাঁধ নির্মাণ এবং প্রাকৃতিক জলাশয় প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১৭)জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং জলবায়ুজনিত রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশুদ্ধ পানি ও উন্নত পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

১৮)বন্টন ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ করা, জ্বালানীর সু-ব্যবহার নিশ্চিত করা, পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণ উৎসের ব্যবহার করা, একটিমাত্র শক্তির উৎস থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে।

১৯)রাস্তার নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ মানানসই অবকাঠামো নির্মাণ করা।

২০)যুগোপযুগী পরিবেশ ও ভোক্তা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

২১)আইনের সঠিক প্রয়োগ ও শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে।

২২)জনগণের পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

২৩)পরিবেশ বিপর্যয় রোধ এবং গ্রিন হাউস ইফেক্ট বন্ধ করতে সরকারি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

২৪)আর এ বিষয়ে সরকার,NGO ও জনগণ সকলকে সম্মিলিতভাবে কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয়

সাম্প্রতিককালে জলবায়ু পরিবর্তনের যে আকস্মিকতা, দ্রুততা ও অনিশ্চয়তা কাজ করছে তার পেছনে প্রধানত মানুষের কর্মকাণ্ডই দায়ী।মানুষকে এ ঝুঁকি থেকে বাঁচার উদ্যোগ নিতে হবে।আর ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যক্তি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সরকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক সংগঠন সকলের ভূমিকাই এক্ষেত্রে মুখ্য।আর সম্মিলিত প্রয়াস জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে সফল করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয় কি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হলো:

ক) কর্মপন্থা প্রণয়ন

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যেসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তা মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই কর্মপন্থা প্রণয়নের দিকে নজর দেওয়া দরকার।

খ) সতর্কতামূলক পথ অবলম্বন

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য প্রত্যেকটি দেশের অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে।আর সে জন্য আন্তর্জাতিক আলোচনায় সবাইকে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে হবে, কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে হবে। যেসব দেশ অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাদের সতর্কতামূলক পথ অবলম্বন করতে হবে।

গ) মনোযোগী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা

আইপিসিসি ১৯৯২ সালে সংকলিত উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনার একটি রিপোর্টে সাগর বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তিন প্রকার অভিযোজন প্রক্রিয়া চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো প্রত্যাহার, উপযোজন সংরক্ষণ এবং যুক্তিসম্মত মনোযোগী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে।

ঘ) জনগণকে সচেতন করা

বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত খবরের ব্যাপক প্রচার ও দ্রুত বিস্তৃতি আধুনিক গণমাধ্যমেরই অবদান।গণমাধ্যম জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারে।এক্ষেত্রে গণমাধ্যম সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম ছাড়া প্রয়োজনীয় তথ্য জনগণের নিকট পৌঁছানো সম্ভব নয়।

ঙ) কম্যুনিটি রেডিও বৃদ্ধি ও ব্যবহার

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ সম্পর্কে বিশ্ববাসী খুবই উদ্বিগ্ন এবং সচেতন। এটাকে আরো অর্থবহ ও কার্যকর করতে কম্যুনিটি রেডিও দ্রুত কাজ করতে পারে।

চ) জমিকে কৃষি উপযোগী করা

পৃথিবীব্যাপী মোট খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ এখনও নির্ণয় করা হয়নি। আর যেসব দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জমিকে কৃষি উপযোগী করা যায় সেখানে সাধারণভাবে কমবেশি স্বল্পকালীন কৃষি উৎপাদন থেকে আয় হ্রাস ও খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আঞ্চলিক ঋতুভিত্তিক ও আন্ত:বার্ষিক পার্থক্য থাকতে পারে। আর বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে চিন্তা করতে হবে এবং বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।

ছ) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালনা

জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলার কৌশল সম্পর্কে সচেতন থেকে সম্ভাবনা, প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, এবং গবেষণা পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের অবশ্যই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।এ সম্পর্কে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত গবেষণা ও তথ্যের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করে জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত হয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে প্রস্তুত থাকতে হবে।

জ) শিল্পোন্নত দেশগুলোর সাবধানতা অবলম্বন

আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর ও নির্মল আবাস স্থল বিনির্মাণের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বার্থের বেড়াজাল ত্যাগ করে শিল্পোন্নত দেশগুলোর এখনই সাবধান হওয়া উচিত।

ঝ) অবকাঠামোকে গুরুত্ব প্রদান

জনসাধারণের খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতাকে বিবেচনায় রেখে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলায় কাঠামোগত পরিকল্পনার পাশাপাশি অবকাঠামোগত বিষয়াদি, যেমন-ব্যাপক ভিত্তিতে বনায়ন, জনসাধারণকে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সহনশীল করে তোলা ইত্যাদি কর্মসূচি জরুরী ভিত্তিতে বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া দরকার।

ঞ) সম্মিলিত প্রয়াস

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে পৃথিবীর জলবায়ু সুরক্ষার জন্য সকল দেশ তথা বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী প্রতিটি দেশই নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার সংরক্ষণ করে। তবে কোনো দেশের কর্মকাণ্ড যাতে অন্য দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি না করে সেদিকে তাদের যত্নবান হতে হবে।

ট) প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত অনেক সমস্যাবলির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।যেমন-অবাধে গাছপালা নিধন ও বনভূমি উজাড় করা, পরিকল্পিতভাবে কলকারখানা স্থাপন ও বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোয়া নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ভূমি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব রোধকল্পের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের অপরিহার্য দাবি।

ঠ) প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ

জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য পৃথিবীর কৃষি, বন ও পশু সম্পদ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পোন্নত দেশ সমূহ যদি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাহলে বায়ুমণ্ডলে সিএফসি-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে না।জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা রোধ করা যাবে।

ড) ঝুঁকি ঠেকাতে কর্মকৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমাধানের প্রচেষ্টায় সম্মিলিত অংশ গ্রহণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। আর পরিবেশ সচেতনতা ও পরিবেশ সাক্ষরতা, পরিবেশ সংরক্ষণের প্রধান শর্ত।

শেষ কথা

উপর্যুক্ত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী। তাদের বিবেচনাহীন উন্নয়নের কারণেই পুরো পৃথিবীর জীবজগৎ আজ হুমকির সম্মুখীন।তাই পুরো বিশ্বের সকল জাতিকে একযোগে উপরিউক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে করে আমরা একটি সুন্দর পৃথিবী আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দিতে পারি। আজকের আর্টিকেলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয় কি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url