নগরায়ন কাকে বলে-বাংলাদেশে নগরায়নের উপাদান সমূহ আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে নগরায়ন কাকে বলে- বাংলাদেশে নগরায়নের উপাদান সমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব।তাই আর্টিকেলটি না টেনে সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনার অনেক উপকৃত হবেন।
নগর মানুষের অনন্য সৃষ্টি। নগর শব্দের উৎপত্তি হয় প্রাচীন গ্রিসে।আর বর্তমানে নগর বলতে প্রধানত অকৃষি পেশায় নিয়োজিত মানব বসতিকে নির্দেশ করে।
ভূমিকা
শিল্প বিপ্লব ও তৎপরবর্তী শিল্পায়নের সাথে সরাসরি ভাবে সংশ্লিষ্ট ঘটনা হলো শহরায়ন বা নগরায়ন।আধুনিক সভ্য জগতের অন্যতম প্রধান বাহন হলো এই শহরায়ন। মূলত শহরায়ন বা নগরায়ন মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নানাবিধ পরিবর্তন সাধনের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাছাড়া শিল্পায়িত সমাজকে বাস্তবে রূপায়ণের ক্ষেত্রে নগরায়ন কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।তবে এর ফলে সৃষ্ট নবতর জীবনযাত্রা প্রণালী সভ্য সমাজের মানুষের জীবনে সফলতার আনয়নে মূখ্য অবদান রাখছে।এছাড়া নগরায়নের আধুনিক জীবনযাত্রার গতিশীলতা নতুন নতুন আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করছে যার প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রেও যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা।
নগর শব্দের উৎপত্তি ও অর্থ
নগর শব্দের উৎপত্তি হয় প্রাচীন গ্রিসে।আর নগর শব্দের আভিধানিক অর্থ হল পর্বততুল্য প্রাসাদময় পুরী বা পর্বত তুল্য প্রাসাদ।নগর শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে 'নগ'এবং'র'-এর সমন্বয়ে।'নগ' অর্থ পর্বত', 'র' অর্থ সভ্যরূপে পতিত হওয়া'। নগর শব্দের অর্থ হচ্ছে 'সভ্যরূপী পর্বতবাসী'।এ ধরনের অর্থ হওয়ার কারণ, গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে প্রথমে নিরাপত্তার জন্য একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের উপর নগর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
শহরায়ন/নগরায়নের সংজ্ঞা:
সাধারণ অর্থে বলা যায় যে, গ্রামীণ মানুষের ক্রমান্বয়ে শহরমুখী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে বসবাস করার নামই হলো শহরায়ন বা নগরায়ন। ব্যাপক অর্থে, শহরায়ন বা নগরায়ন হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ কৃষিভিত্তিক পেশা বা জীবনব্যবস্থা থেকে অকৃষি পেশা যা জীবনযাপন প্রণালীতে ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত বা রূপান্তরিত হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা
জার্মান ভূগোলবিদ রাটজেল (Ratzel)-এর মতে,"বিরাট এলাকা নিয়ে বিস্তৃত এবং বৃহৎ বাণিজ্য পথ সমূহের ফোকাস বিন্দুতে অবস্থিত ধারাবাহিক ও অধিক জনঘনত্ব সম্পন্ন পুঞ্জীভূত বসতিই হচ্ছে নগর।"
কিংসলে ডেভিস (Kingsley Davis) বলেন, "শহরায়ন বা নগরায়ন হলো শহরে বসবাসকারী জনসংখ্যার এমন একটি বৃহৎ বা পরিমিত অংশ যা সমাজের অন্যতম বিষয়গুলো; যেমন- ভাষা, ধর্ম, গোত্র, সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে তুলনামূলকভাবে আলোচিত হয়।"
এইচ.ডি.ক্যামেয়ার (H.D. Kammeier) তার 'Term Concepts in Planning' গ্রন্থে বলেন,"শহরায়ন বলতে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক,অর্থনৈতিক এবং প্রাকৃতিক বিকাশকে বুঝায় যাতে দেশের জনসংখ্যা মোতাবেক নগরের সমৃদ্ধি রূপায়িত হয়।"
ফ্রান্সিস চেরুনিলাম(Francis Cherunilam)-এর মতে, "একটি জাতির জনসংখ্যার নির্দিষ্ট অংশের শহর/নগর এলাকায় বসবাস করাই হলো শহরায়ন বা নগরায়ন।"
এ.লুইস উইথ(A.Louise Weith)তার 'Urbanisation is a Way of Life 'গ্রন্থে বলেন,"শহরায়ন ধারণা বলতে কতগুলো শহরীয়/নগরীয় বৈশিষ্ট্যের প্রভাবাধীন জীবন যাত্রার বিশেষ ধারণাকে বুঝায়।"
নীল এন্ডারসন (Nel Anderson) -এর মতে,"শহরায়ন জটিল এবং সরল উভয়ভাবেই জীবন চলার পাথেয় সৃষ্টি করে এবং ক্রমান্বয়ে এরূপ ভাবে অগ্রসর হতে থাকে। এভাবেই শহরবাসীরা ক্রমান্বয়ে আরো বেশি দক্ষ, নিপুণ ও অভিজাতসম্পন্ন হয়ে উঠে যা গ্রামের ঐতিহ্যসম্পন্ন চলার পথ অপেক্ষা অধিক হারে পার্থক্য সৃষ্টি করে।"
ডব্লিউ.এস.থমসন (W.S. Thompson)-এর মতে, "একটি সম্প্রদায় যখন কোনো নির্দিষ্ট সংশ্রব থেকে অন্য একটি সংশ্রবে আসে এবং বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক পেশা ছেড়ে অকৃষি ভিত্তিক পেশা গ্রহণের মাধ্যমে শহর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে তখন তাকে শহরায়ন/নগরায়ন বলে।"
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে,"গ্রামীন এলাকা থেকে পৌর এলাকায় মানুষের আগমন এবং গ্রামীণ এলাকা অপেক্ষা পৌর এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধি পাওয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে শহরায়ন/নগরায়ন।"
মিচেল (Mitchel)-এর মতে,"শহরায়ন/নগরায়ন বলতে কৃষিভিত্তিক জীবনযাপন থেকে শহুরে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও রীতিনীতির বিকাশকে বুঝায়।"
অধ্যাপক আব্দুল বাকী বলেন,"শহরায়ন একটি প্রক্রিয়া; এর মাধ্যমে গ্রামীণ পরিসরের একদল লোক কৃষিক্ষেত্র থেকে শহরের তৃতীয় পর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে।"
কাজী মারুফার মতে,"মানবিক ভূগোলের বিভিন্ন রীতি বদ্ধ শাখাগুলোর সমকেন্দ্রাভিমুখী সংশ্লেষণ ক্ষেত্রে স্থান গত ও কলাকৌশলগত বিশ্লেষণে শহরের ক্রমোন্নতিকে শহরায়ন বলে।"
'The New Encyclopaedia of Britannica'-তে বলা হয়েছে যে, "শহরায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেটি মানুষকে শহুরে জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, "শহরায়ন/নগরায়ন বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝায় যাতে দেশের জনসংখ্যার একটি ক্রমবর্ধমান অংশ শহরে বা নগরে বাস করে।"
আর.বি. মণ্ডল (R.B.Mandal) বলেন,"শহর এলাকায় জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে শহরায়ন বলে।"
সুতরাং উপরিউক্ত সংজ্ঞা গুলোর আলোকে বলা যায় যে, শহরায়ন/নগরায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ উন্নত জীবনযাপনের আশায় বা বাধ্য হয়ে অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বসবাসের জন্য শহরে আগমন করে শহরের আয়তনকে বর্ধিত করে।মোটকথা শহরায়ন বলতে শহরের উদ্ভব,বিকাশ ও বৃদ্ধিকে বুঝানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে শহরায়ন/নগরায়নের নিয়ামক/উপাদান
নিম্নে বাংলাদেশে শহরায়নের/নগরায়নের কতিপয় নিয়ামক বা উপাদানের বর্ণনা দেওয়া হলো:
১) উপযুক্ত জলবায়ু
শহরায়নের জন্য অনুকূল জলবায়ুর গুরুত্ব অপরিসীম। অনুকূল জলবায়ু ছাড়া শহরায়ন কল্পনা করা যায় না। প্রাচীনকালে নদী অববাহিকায় শহর গড়ে উঠার প্রধান কারণ ছিল অনুকূল জলবায়ু।বাংলাদেশেও সেই আদি কাল থেকে নদী অববাহিকায় মানুষ বসবাস করতে শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এসব অঞ্চলে শহরায়ন ত্বরানিত হয়। যেমন- ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, গোয়ালন্দ প্রভৃতি।
২) উঁচু সমতল ভূমি
শহর প্রতিষ্ঠার জন্য উঁচু সমতল ভূমি বিশেষ প্রয়োজন। কারণ নিম্ন ভূমিতে শহরায়ন হলে তা অনেক সময় বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আবার পাহাড়ি বন্ধুর ভূমিতেও শহরায়ন হওয়া অনেক সময় সাপেক্ষ এবং কঠিন ব্যাপার। ফলে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শহরায়ন উঁচু সমতল ভূমিতে হয়েছে।বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৩) যোগাযোগ ব্যবস্থা
শহরায়নের অন্যতম নিয়ামক হলো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা।যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে শহরায়ন সম্প্রসারিত হতে পারে না।পৃথিবীর প্রত্যেকটি নগর উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার আশেপাশে বা সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিভিন্ন রকমের হতে পারে; যেমন-সড়কপথ, নৌপথ অথবা আকাশপথ।
বর্তমানে আবার যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। ফলে এক শহরের সাথে অন্যান্য শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর শহরে শহরে যত বেশি যোগাযোগ হবে, শহরায়নের অগ্রযাত্রা ততই বৃদ্ধি পাবে। যেমন- ঢাকা মহানগরী বৃদ্ধি পাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থা।
৪) বাণিজ্য কেন্দ্র
শহরায়নের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো বাণিজ্য কেন্দ্র। বাণিজ্য কেন্দ্রে দেশ-বিদেশের অগণিত লোক আসে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য।এখানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আগত লোকজন এবং তাদের সেবা প্রদানের জন্য স্থানীয় লোকজনের সমন্বয়ে সেখানে শহর সম্প্রসারিত হয়। যেমন- ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ,বরিশাল,বেনাপোল,মংলা,চাঁদপুর, ভৈরব প্রভৃতি অঞ্চলে শহরায়ন বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে বাণিজ্য কেন্দ্রে স্থাপিত হওয়া।
৫) রাজধানী
যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে রাজধানী হলো শহরায়নের জন্য অন্যতম প্রধান উপাদান।বিশ্বের সব দেশেই রাজধানীকে কেন্দ্র করে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়েছে। রাজধানীকে ঘিরে সকল অফিস-আদালত, স্কুল- কলেজ, বিনোদন কেন্দ্র,শিল্প-কারখানা,বিশ্ববিদ্যালয়,সেনানিবাস,চিকিৎসা কেন্দ্র প্রভৃতি গড়ে উঠে।এর ফলে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়।বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাভার, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গী প্রভৃতি এলাকায় শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়েছে।
৬) শিক্ষা কেন্দ্র
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহর সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শিক্ষা লাভের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল অথবা বিদেশ থেকে অনেকে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসে।যার ফলে বাইরের থেকে আগতদের দ্বারা শহরায়ন অনেক বৃদ্ধি পায়। যেমন-বাংলাদেশের রাজশাহীকে শিক্ষা শহর বলা হয়, কারণ এখানকার শহরায়ন সংঘটিত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নির্ভর করে। এছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠায় শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়েছে।
৭) চিকিৎসা কেন্দ্র
চিকিৎসা কেন্দ্র শহরায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষ দেশ-বিদেশ থেকে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য চিকিৎসা কেন্দ্রে আসে। ফলে চিকিৎসা কেন্দ্রকে ঘিরে নতুন নতুন শহর/নগর গড়ে উঠে এবং পরবর্তী পর্যায়ে শহরায়ন/নগরায়ন সম্প্রসারিত হয়। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশে চিকিৎসা কেন্দ্রকে ঘিরে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়েছে। আর বাংলাদেশেও ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে উঠায় এসব অঞ্চলে শহরায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।
৮) দর্শনীয় স্থান
শহরায়নের ক্ষেত্রে দর্শনীয় স্থান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, রাজপ্রাসাদ, বাড়ি-ঘর প্রভৃতি পুরাতন ঐতিহ্য দেখার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। ফলে দর্শনীয় স্থানকে ঘিরে শহরায়নের সম্প্রসারণ ঘটে।যেমন-চীনের প্রাচীর, ভারতের তাজমহল, মিশরের পিরামিড প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান ও ভাস্কর্য দেখার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর দর্শকের আগমন ঘটায় সেসব স্থানে শহরায়ন সমৃদ্ধশালী হয়েছে।বাংলাদেশের ময়নামতি, মহাস্থানগড়, সোনারগাঁ, সোমপুর বিহার, ঢাকার বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সমূহ প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়েছে।
৯) প্রশাসনিক কেন্দ্র
শহরায়নের অন্যতম উপাদান হলো প্রশাসনিক কেন্দ্র। প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তর বা দপ্তর রয়েছে।যেমন- রাজধানী,বিভাগ জেলা, উপজেলা, থানা প্রভৃতি। এসব প্রশাসনিক স্তর বা দপ্তরকে ঘিরে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়।
১০) পবিত্র স্থান
শহরায়ন বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো পবিত্র স্থান। পবিত্র স্থানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোক আগমন করে।ফলে সেখানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। দেশ বিদেশের মানুষের যাতায়াতের ফলে পবিত্র স্থানকে ঘিরে শহরায়নের সূত্রপাত ঘটে।আর পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় সেখানে বিশাল শহর/নগর গড়ে উঠে এবং শহরায়ন/নগরায়ন বৃদ্ধি পায়।বিশ্বের প্রধান প্রধান পবিত্র স্থানে এ ধরনের শহরায়ন/নগরায়ন সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- মক্কা,মদিনা,রোম,গয়া,কাশী,জেরুজালেম,বাংলাদেশের চট্টগ্রাম,সিলেট প্রভৃতি স্থানের পবিত্র স্থানকে কেন্দ্র করে শহরায়ন প্রক্রিয়া সম্প্রসারিত হয়েছে।
১১) সেনানিবাস
যেকোনো দেশের শহরায়নের পিছনে সেনানিবাসের বিশেষ অবদান রয়েছে।সেনানিবাস শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে। তাই নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায় সেনানিবাসকে ঘিরে শহরায়ন বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সেনানিবাসকে কেন্দ্র করে শহরায়ন প্রক্রিয়া সম্প্রসারিত হয়েছে। যেমন- ঢাকা সেনানিবাস, সাভার সেনানিবাস, রাজশাহী সেনানিবাস, বগুড়া সেনানিবাস, কাদিরাবাদ সেনানিবাস, রাঙ্গামাটি সেনানিবাস, কুমিল্লা সেনানিবাস, সৈয়দপুর সেনানিবাস, চট্টগ্রাম সেনানিবাস, যশোর সেনানিবাস প্রভৃতি।
১২) সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
শহরায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বিশ্বের অনেক দেশে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে ঘিরে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়েছে। যেমন-ভারতের মুম্বাই, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড ইত্যাদি।এসব সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অনেক লোকের আগমন ঘটে বিধায় এখানে শহরায়ন সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, নাটোর, বরিশাল, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, প্রভৃতি অঞ্চলে বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র; যেমন- চিড়িয়াখানা, নাট্যশালা, জাদুঘর, শিশুপার্ক,পার্ক ইত্যাদি গড়ে উঠার কারণে সেসব অঞ্চলে শহর সম্প্রসারিত হয়েছে।
১৩) শহরের আকর্ষণ
শহর বা নগর সব সময় মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষ তার আকর্ষণে সাড়া দিয়ে শহরে আগমন করে। শহরের রূপ-সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পয়:নিষ্কাশন,টেলিফোন,বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতির সুযোগ-সুবিধা গ্রামের মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফলে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য। যার ফলে অধিক হারে শহরায়ন ঘটে।
১৪) আর্থ-সামাজিক সমস্যা
আর্থ-সামাজিক সমস্যার কারণে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়। আর্থ-সামাজিক সমস্যার পিছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান থাকে। ফলে শহরায়ন সংঘটিত হয়।যেমন-নদী ভাঙ্গন,ভূমিহীনতা,বেকারত্ব, দারিদ্র্য,বস্তি,অপরাধপ্রবণতা প্রভৃতি। আর এইসব সমস্যার কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত শহরাভিমুখী হয় বিধায় শহরায়ন সম্প্রসারিত হচ্ছে।
১৫) প্রকৃতি দর্শন/পর্যটন কেন্দ্র
প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পাহাড়,পর্বত, অরণ্য, সমুদ্র সৈকত,হ্রদ,দ্বীপ, জলপ্রপাত প্রভৃতি পর্যটন কেন্দ্রে গমন করে। এ কারণে এসব সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানে শহরায়ন সম্প্রসারিত হয়। ভারত, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, নেপাল, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে শহরায়ন সমৃদ্ধি লাভ করেছে।এছাড়া বাংলাদেশের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, টেকনাফ, বান্দরবান, কুয়াকাটা,সুন্দরবন প্রভৃতি অঞ্চলে শহরায়ন/নগরায়ন সম্প্রসারিত হওয়ার জন্য প্রকৃতি বিলাসীদের অবদান অনস্বীকার্য।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,শহর/নগরায়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া যার পিছনে নানাবিধ উপাদান বা কারণ বর্তমান। শহরায়নের ধারা বর্তমানে অতি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে শহরায়নের হার অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।এর প্রধান কারণ হচ্ছে, গ্রাম থেকে শহর বা নগরমুখী অভিগমন। আর এ অভিগমন রোধ করা সম্ভব নয়। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা মাফিক শহরায়ন/নগরায়ন সম্প্রসারণ। আমরা যদি এটি করতে ব্যর্থ হই তাহলে বাংলাদেশের শহর বাসীদের জীবন হুমকির সম্মুখীন হবে।সুতরাং আজকের আর্টিকেলে নগরায়ন কাকে বলে-বাংলাদেশে নগরায়নের উপাদান সমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।